আম-আঁটির ভেঁপু | বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়: সকাল বেলা। আটটা কি নয়টা। হরিহরের পুত্র আপন মনে রােয়াকে বসিয়া খেলা করিতেছে, তাহার একটা ছােট টিনের বাক্স আছে, সেটার ডালা ভাঙা। বাক্সের সমুদয় সম্পত্তি সে উপুড় করিয়া মেঝেতে ঢালিয়াছে। একটা রং-ওঠা কাঠের ঘােড়া, চার পয়সা দামের একটা টো-খাওয়া টিনের ভেঁপু-বাঁশি, গােটাকতক কড়ি।
এগুলি সে মায়ের অজ্ঞাতসারে লক্ষ্মীপূজার কড়ির চুপড়ি হইতে খুলিয়া লইয়াছিল ও পাছে কেহ টের পায় এই ভয়ে সর্বদা লুকাইয়া রাখে- একটা দু’পয়সা দামের পিস্তল, কতকগুলাে শুকনাে নাটা ফল। দেখিতে ভালাে বলিয়া তাহার দিদি কোথা হইতে অনেকগুলি কুড়াইয়া আনিয়াছিল, কিছু তাহাকে দিয়াছে, কিছু নিজের পুতুলের বাক্সে রাখিয়া দিয়াছে।
আম-আঁটির ভেঁপু | বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
খানকতক খাপরার কুচি। গঙ্গা-যমুনা খেলিতে এই খাপরাগুলির লক্ষ্য অব্যর্থ বলিয়া বিশ্বাস হওয়ায় সে এগুলি সযত্নে বাক্সে রাখিয়া দিয়াছে, এগুলি তাহার মহামূল্যবান সম্পত্তি এতগুলি জিনিসের মধ্যে সবে সে টিনের বাঁশিটা কয়েকবার বাজাইয়া সেটির সম্বন্ধে বিগত কৌতুহল হইয়া তাহাকে একপাশে রাখিয়া দিয়াছে।
কাঠের ঘােড়া নাড়াচাড়া করা হইয়া গিয়াছে। সেটিও একপাশে পিজরাপােলের আসামির ন্যায় পড়িয়া আছে। বর্তমানে সে গঙ্গা-যমুনা খেলিবার খাপরাগুলিকে হাতে লইয়া মনে মনে দাওয়ার উপর গঙ্গা-যমুনার ঘর আঁকা কল্পনা করিয়া চোখ বুজিয়া খাপরা ভূঁইয়া দেখিতেছে তাক ঠিক হইতেছে কি না!
এমন সময়ে তাহার দিদি দুর্গা উঠানের কাঁঠালতলা হইতে ডাকিল-অপু- ও অপু। সে এতক্ষণ বাড়ি ছিল না, কোথা হইতে এইমাত্র আসিল। তাহার স্বর একটু সতর্কতা মিশ্রিত। মানুষের গলার আওয়াজ পাইয়া অপু কলের পুতুলের মতাে লক্ষ্মীর চুপড়ির কড়িগুলি তাড়াতাড়ি লুকাইয়া ফেলিল। পরে বলিল- কি রে দিদি?
দুর্গা হাত নাড়িয়া ডাকিল- আয় এদিকে- শােদুর্গার বয়স দশ-এগারাে বৎসর হইল। গড়ন পাতলা পাতলা, রং অপুর মতাে অতটা ফর্সা নয়, একটু চাপা। হাতে কাচের চুড়ি, পরনে ময়লা কাপড়, মাথার চুল রুক্ষ- বাতাসে উড়িতেছে, মুখের গড়ন ও মন্দ নয়, অপুর মতাে চোখগুলি বেশ ডাগর ডাগর। অপু রােয়াক হইতে নামিয়া কাছে গেল, বলিল,-কে রে? ”
দুর্গার হাতে একটা নারিকেলের মালা! সেটা সে নিচু করিয়া দেখাইল, কতকগুলি কচি আম কাটা। সুর নিচু করিয়া বলিল- মা ঘাট থেকে আসে নি তাে?
অপু ঘাড় নাড়িয়া বলিল- উঁহুদুর্গা চুপিচুপি বলিল – একটু তেল আর একটু নুন নিয়ে আসতে পারিস?
আমের কুশি জারাববা – অপু আহাদের সহিত বলিয়া উঠিল – কোথায় পেলি রে দিদি? দুর্গা বলিল-পটলিদের বাগানে সিঁদুরকৌটোর তলায় পড়ে ছিল – আন্ দিকি একটু নুন আর তেল। অপু দিদির দিকে চাহিয়া বলিল – তেলের ভাড় ছুঁলে মা মারবে যে?
আমার কাপড় যে বাসি? – তুই যা না শিগগিরি করে, মা’র আসতে এখন ঢের দেরি-ক্ষার কাচতে গিয়েচে শিগগির যাঅপু বলিল- নারকোলের মালাটা আমায় দে। ওতে ঢেলে নিয়ে আসবাে- তুই খিড়কি দোরে গিয়ে দ্যাখ মা আসছে কি না।
দুর্গা নিম্নস্বরে বলিল- তেলটেল যেন মেঝেতে ঢালিসনে, সাবধানে নিবি, নইলে মা টের পাবেতুই তাে একটা হাবা ছেলেঅপু বাড়ি মধ্য হইতে বাহির হইয়া আসিলে দুর্গা তাহার হাত হইতে মালা লইয়া আমগুলি বেশ করিয়া মাখিল,- বলিল, নে হাত পাত।
আম-আঁটির ভেঁপু | বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
তুই অতগুলাে খাবি দিদি? – অতগুলি বুঝি হলাে? এই তাে- ভারি বেশি- যা, আচ্ছা নে আর দু’খানা- বাঃ, দেখতে বেশ হয়েচে রে, একটা লঙ্কা আনতে পারিস? আর একখানা দেবাে তা হলে- লঙ্কা কী করে পাড়বাে দিদি? মা যে তক্তার ওপর রেখে দ্যায়, আমি যে নাগাল পাই নে? – তবে থাকগে যাক্ – আবার ওবেলা আনবাে এখন-পটলিদের ডােবার ধারের আমগাছটায় গুটি যা ধরেচে – দুপুরের রােদে তলায় ঝরে পড়েদুর্গাদের বাড়ির চারিদিকেই জঙ্গল।
হরিহর রায়ের জ্ঞাতি-ভ্রাতা নীলমণি রায় সম্প্রতি গত বত্সর মারা গিয়াছেন, তাঁহার স্ত্রী পুত্রকন্যা লইয়া নিজ পিত্রালয়ে বাস করিতেছেন। কাজেই পাশের এ ভিটাও জঙ্গলাবৃত হইয়া পড়িয়া আছে। নিকটে আর কোনাে লােকের বাড়ি নাই।
পাঁচ মিনিটের পথ গেলে তবে ভুবন মুখুয্যের বাড়ি। হরিহরের বাড়িটাও অনেকদিন হইয়া গেল মেরামত হয় নাই, সামনের দিকের রােয়াক ভাঙা, ফাটলে বন-বিছুটির ও কালমেঘ গাছের বন গজাইয়াছে- ঘরের দোর জানালার কপাট সব ভাঙা, নারিকেলের দড়ি দিয়া গরাদের সঙ্গে বাঁধা আছে। খিড়কি দোর ঝনাৎ করিয়া খুলিবার শব্দ হইল এবং একটু পরেই সর্বজয়ার গলা শুনা গেল-দুগ্গা, ওদুগ্গা* দুর্গা বলিল-মা ডাকছে, যা দেখে আয়-ওখানা খেয়ে যা-মুখে যেনুনের গুঁড়াে লেগে আছে, মুছে ফ্যা
মায়ের ডাক আর একবার কানে গেলেও দুর্গার এখন উত্তর দিবার সুযােগ নাই, মুখ ভর্তি। সে তাড়াতাড়ি জারানাে আমের চাকলাগুলি খাইতে লাগিল। পরে এখনাে অনেক অবশিষ্ট আছে দেখিয়া কাঁঠালগাছটার কাছে সরিয়া গিয়া গুড়ির আড়ালে দাঁড়াইয়া সেগুলি গােগ্রাসে গিলিতে লাগিল।
অপু তাহার পাশে দাঁড়াইয়া নিজের অংশ প্রাণপণে গিলিতেছিল, কারণ চিবাইয়া খাওয়ার আর সময় নাই। খাইতে খাইতে দিদির দিকে চাহিয়া সে দোষ সম্বন্ধে সচেতনতাসূচক হাসি হাসিল। দুর্গা খালি মালাটা এক টা মারিয়া ভেরেণ্ডাকচার বেড়া পার করিয়া নীলমণি রায়ের ভিটার দিকে জঙ্গলের মধ্যে ছুঁড়িয়া দিল।
ভাইয়ের দিকে চাহিয়া বলিল- মুখটা মুছে ফ্যাল্ না বাঁদর, নুন লেগে রয়েছে যে … পরে দুর্গা নিরীহমুখে বাড়ির মধ্যে ঢুকিয়া বলিল- কী মা? -কোথায় বেরুনাে হয়েছিল শুনি? একলা নিজে কতদিকে যাবাে? সকাল থেকে ক্ষার কেচে গাগতর ব্যথা হয়ে গেল, একটুখানি কুটোগাছটা ভেঙে দু খানা করা নেই, কেবল পাড়ায় পাড়ায় টোটো টোকলা সেধে বেড়াচ্ছেন- সে বাঁদর কোথায়?
অপু আসিয়া বলিল, মা, খিদে পেয়েছে। -রােসাে রােসাে, একটুখানি দাঁড়াও বাপু … একটুখানি হাঁপ জিরােতে দ্যাও। তােমাদের রাতদিন খিদে আর রাতদিন ফাইফরমাজ! ও দুগগা, দ্যাখ তাে বাছুরটা হাঁক পাড়ছে কেন? খানিকটা পরে সর্বজয়া রান্নাঘরের দাওয়ায় বঁটি পাতিয়া শসা কাটিতে বসিল। অপু কাছে বসিয়া পড়িয়া বলিল -আর এটু আটা বের করাে না মা, মুকে বড় লাগে!
দুর্গা নিজের ভাগ হাত পাতিয়া লইয়া সঙ্কুচিত সুরে বলিল- চালভাজা আর নেই মা? অপু খাইতে খাইতে বলিল- উঃ, চিবনাে যায় না। আম খেয়ে দাঁত টকেদুর্গার ভ্রুকুটিমিশ্রিত চোখটেপায় বাধা পাইয়া তাহার কথা অর্ধপথেই বন্ধ হইয়া গেল। তাহার মা জিজ্ঞাসা করিল,- আম কোথায় পেলি? সত্য কথা প্রকাশ করিতে সাহসী না হইয়া অপু দিদির দিকে জিজ্ঞাসাসূচক দৃষ্টিতে চাহিল।
সর্বজয়া মেয়ের দিকে চাহিয়া বলিল- তুই ফের এখন বেরিয়েছিলি বুঝি? দুর্গা বিপন্নমুখে বলিল- ওকে জিজ্ঞেস করাে না? আমি- এই তাে এখন কাঁঠালতলায় দাঁড়িয়েতুমি যখন ডাকলে তখন তােস্বর্ণ গােয়ালিনী গাই দুহিতে আসায় কথাটা চাপা পড়িয়া গেল। তাহার মা বলিল- যা, বাছুরটা ধরগে যা ডেকে সারা হােলাে- কমলে বাছুর, ও সন্ন, এত বেলা করে এলে কি বাঁচে?
একটু সকাল করে না এলে এই তেতল্পর পজ্জন্ত বাছুর বাঁধাদিদির পিছনে পিছনে অপুও দুধ দোয়া দেখিতে গেল। সে বাহির উঠানে পা দিতেই দুর্গা হাতার পিঠে দুম্ করিয়া নির্ঘাত এক কিল বসাইয়া দিয়া কহিললক্ষ্মীছাড়া বাঁদর! পরে মুখ ভ্যাঙাইয়া কহিলআম খেয়ে দাঁত টকে গিয়েছে।
আবার কোনােদিন আম দেবাে খেও- ছাই দেবাে-এই ওবেলাই পটলিদের কাঁকুড়তলির আম কুড়িয়ে এনে জারাবাে, এত বড় বড় গুটি হয়েছে, মিষ্টি যেন গুড়- দেবব ও তােমায়? খেও এখন?হাবা একটা কোথাকার- যদি এতটুকু বুদ্ধি থাকে!
দুপুরের কিছু পরে হরিহর কাজ সারিয়া বাড়ি ফিরিল। সে আজকাল গ্রামের অন্নদা রায়ের বাটীতে গােমস্তার কাজ করে। জিজ্ঞাসা করিল- অপুকে দেখচি নে? সর্বজয়া বলিল- অপু তাে ঘরে ঘুমুচ্ছে। -দুগগা বুঝি-সে সেই খেয়ে বেরিয়েছে- সে বাড়ি থাকে কখন?
দুটো খাওয়ার সঙ্গে যা সম্পর্ক! আবার সেই খিদে পেলে তবে আসবে- কোথায় কার বাগানে কার আমতলায় জামতলায় ঘুরছে- এই চত্তির মাসের রােদুরে, ফের দ্যাখাে না এই জ্বরে পড়লাে বলে- অত বড় মেয়ে, বলে বােঝাবাে কত? কথা শােনে, না কানে নেয়?
একটু পরে হরিহর খাইতে বসিয়া বলিল- আজ দশঘরায় তাগাদার জন্যে গেছলাম, বুঝলে? একজন | লােক,খুব মাতবর, পাঁচটা-ছয়টা গােলা বাড়িতে, বেশ পয়সাওয়ালা লােক- আমায় দেখে দণ্ডবৎ করে বল্লেদাদাঠাকুর, আমায় চিনতে পাচ্ছেন?
আমি বল্লাম- না বাপু, আমি তাে কৈ?- বল্লে- আপনার কর্তা থাকতে তখন তখন পূজা-আচ্চায় সবসময়ই তিনি আসতেন, পায়ের ধুলাে দিতেন। আপনারা আমাদের গুরুতুল্য লােক, এবার আমরা বাড়িসুদ্ধ মন্তর নেবাে ভাবচি- তা আপনি যদি আজ্ঞে করেন,
তবে ভরসা করে বলি- আপনিই কেন মন্তরটা দেন না? তা আমি তাদের বলেচি আজ আর কোনাে কথা বলবাে না, ঘুরে এসে দু-একদিনে বুঝলে? সর্বজয়া ডালের বাটি হাতে দাঁড়াইয়া ছিল, বাটি মেজেতে নামাইয়া সামনে বসিয়া পড়িল। বলিলহ্যাগাে, তা মন্দ কী? দাও না ওদের মন্তর? কী জাত? হরিহর সুর নামাইয়া বলিল- বলাে না কাউকে!- সদৃগােপ।
তােমার তাে আবার গল্প করে বেড়াননা স্বভাব-আমি আবার কাকে বলতে যাবাে, তা হােক গে সদৃগােপ, দাও গিয়ে দিয়ে, এই কষ্ট যাচ্ছে- ঐ রায়বাড়ির আটটা টাকা ভরসা, তাও দু’তিন মাস অন্তর তবে দ্যায়- আর এদিকে রাজ্যের দেনা। কাল ঘাটের পথে সেজ ঠান বল্লে- বৌমা, আমি বন্দক ছাড়া টাকা ধার দিই নে- তবে তুমি অনেক করে বল্লে বলে দিলাম- আজ পাঁচ পাঁচ মাস হয়ে গেল, টাকা আর রাখতে পারবাে না।
এদিকে রাধা বােষ্টমের বৌ তাে ছিড়ে খাচ্ছে, দু’বেলা তাগাদা আরম্ভ করেছে। ছেলেটার কাপড় নেইদু’তিন জায়গায় সেলাই, বাছা আমার তাই পরে হাসিমুখে নেচে নেচে বেড়ায় আমার এমন হয়েছে যে ইচ্ছে করে একদিকে বেরিয়ে যাই-আর একটা কথা ওরা বলছিল, বুঝলে? বলছিল গায়ে তাে বামুন নেই, আপনি যদি এই গাঁয়ে উঠে আসেন, তবে জায়গা জমি দিয়ে বাস করাই- গাঁয়ে একঘর বামুন বাস করানাে আমাদের বড় ইচ্ছে।
তা কিছু ধানের জমিটমি দিতেও রাজি- পয়সার তাে অভাব নেই! আজকাল চাষাদের ও ঘরে লক্ষ্মী বাধা- ভদ্দর লােকেরই হয়ে পড়েচে হা ভাত যাে ভাত আগ্রহে সর্বজয়ার কথা বন্ধ হইবার উপক্রম হইল- এখুনি। তা তুমি রাজি হলে না কেন? বল্লেই হতাে যে আচ্ছা আমরা আসবাে! ও রকম একটা বড় মানুষের আশ্রয়- এ গায়ে তােমার আছে কী? শুধু ভিটে কামড়ে পড়ে থাকাহরিহর হাসিয়া বলিল- পাগল! তখুনি কি রাজি হতে আছে?
ছছাটলােক, ভাববে ঠাকুরের হাঁড়ি দেখচি শিকেয় উঠেচে- উঁহু, ওতে খেলাে হয়ে যেতে হয় তা নয়, দেখি একবার চুপি চুপি মজুমদার মহাশয়ের সঙ্গে পরামর্শ করে- আর এখন ওঠ বল্লেই কী ওঠা চলে?
সব ব্যাটা এসে বলবে টাকা দাও, নৈলে যেতে দেবাে না- দেখি পরামর্শ করে কি রকম দাঁড়ায়এই সময়ে মেয়ে দুর্গা কোথা হইতে পা টিপিয়া টিপিয়া আসিয়া বাহিরের দুয়ারের আড়াল হইতে সতর্কতার সহিত একবার উঁকি মারিল এবং অপর পক্ষ সম্পূর্ণ সজাগ দেখিয়া ওধারে পাঁচিলের পাশ বাহিয়া বাহির বাটীর রােয়াকে উঠিল ।
দালানের দুয়ার আস্তে আস্তে ঠেলিয়া দেখিল উহা বন্ধ আছে। এদিকে রােয়াকে দাঁড়ানাে অসম্ভব, রৌদ্রের তাপে পা পুড়িয়া যায়, কাজেই সে স্থান হইতে নামিয়া গিয়া উঠানের কাঁঠালতলায় দাঁড়াইল। রৌদ্রে বেড়াইয়া তাহার মুখ রাঙা হইয়া উঠিয়াছে, আঁচলের খুঁটে কী কতকগুলাে যত্ন করিয়া বাঁধা।
সে আসিয়াছিল এইজন্য যে, যদি বাহিরের দুয়ার খােলা পায় এবং মা ঘুমাইয়া থাকে, তবে ঘরের মধ্যে চুপি চুপি ঢুকিয়া একটু শুইয়া লইবে। কিন্তু বাির, বিশেষত মার সামনে সম্মুখ দুয়ার দিয়া বাড়ি ঢুকিতে তাহার সাহস হইল না ।
উঠানে নামিয়া সে কাঁঠালতলায় দাঁড়াইয়া কী করিবে ঠিক করিতে না পারিয়া নিরুৎসাহভাবে এদিক ওদিক চাহিতে লাগিল। পরে সেখানেই বসিয়া পড়িয়া আঁচলের খুঁট খুলিয়া কতকগুলি শুকনাে রড়া ফলের বিচি বাহির করিল। খানিকক্ষণ চাহিয়া থাকিয়া সে আপন মনে সেগুলি গুনিতে আরম্ভ করিল, এক-দুইতিন-চার … ছাব্বিশটা হইল। পরে সে দুই তিনটা করিয়া বিচি হাতের উল্টা পিঠে বসাইয়া উঁচু করিয়া ঘুড়িয়া দিয়া পরে হাতের সােজা পিঠ পাতিয়া ধরিতে লাগিল।
মনে মনে বলিতে লাগিল – অপুকে এইগুলাে দেবাে – আর এইগুলাে পুতুলের বাক্সে রেখে দেবাে কেমন বিচিগুলি তেল চুকচুক কচ্ছে- আজই গাছ থেকে পড়েছে, ভাগ্যিস আগে গেলাম, নৈলে সব গােরুতে খেয়ে ফেলে দিতাে, ওদের রাঙি গাইটা একেবারে রাক্কস, সব জায়গায় যাবে, সেবার কতকগুলাে এনেছিলাম আর এইগুলাে নিয়ে অনেকগুলাে হলাে।
সে খেলা বন্ধ করিয়া সমস্ত বিচি আবার সযত্নে আঁচলের খুঁটে বাধিল। পরে হঠাৎ কী ভাবিয়া রুক্ষ চুলগুলি বাতাসে উড়াইতে উড়াইতে মহা খুশির সহিত পুনরায় সােজা বাটীর বাহির হইয়া গেল।
লেখক-পরিচিতি : বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
১৮৯৪ সালে ২৪ পরগনার মুরারিপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মহানন্দা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং মাতা মৃণালিনী দেবী। স্থানীয় বনগ্রাম স্কুল থেকে ১৯১৪ সালে তিনি ম্যাট্রিক পাস করেন এবং কলকাতা রিপন কলেজ থেকে আই.এ. এবং বি.এ. ডিগ্রি লাভ করেন।
কর্মজীবনে তিনি হুগলী, কলকাতা ও ব্যারাকপুরের বিভিন্ন স্কুলে শিক্ষকতা করেন। শরশ্চন্দ্রের পরে তিনি বাংলা কথাসাহিত্যের সবচেয়ে জনপ্রিয় শিল্পী। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও গ্রামবাংলার সাধারণ মানুষের সহজ-সরল জীবনযাপনের অসাধারণ এক আলেখ্য নির্মাণ করে তিনি বাংলা কথাসাহিত্যে অমর হয়ে আছেন।
প্রকৃতি এবং মানুষের জীবনের অভিন্ন সম্পর্কের চিরায়ত তাৎপর্যে তাঁর কথাসাহিত্য মহিমামণ্ডিত। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উল্লেখযােগ্য উপন্যাস হলাে : পথের পাঁচালী, অপরাজিত, আরণ্যক, ইছামতি, দৃষ্টিপ্রদীপ। গল্পগ্রন্থ :মেঘমল্লার, মৌরীফুল, যাত্রাবদল। ইছামতি উপন্যাসের জন্য তিনি রবীন্দ্র-পুরস্কারে ভূষিত হন। ১৯৫০ সালের ১লা সেপ্টেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন।]
আরও পড়ুন