উপেক্ষিত শক্তির উদ্বোধন কাজী নজরুল ইসলাম

উপেক্ষিত শক্তির উদ্বোধন | কাজী নজরুল ইসলাম

উপেক্ষিত শক্তির উদ্বোধন | কাজী নজরুল ইসলাম:

“হে মাের দুর্ভাগা দেশ! যাদের করেছ অপমান

  •  অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান।

রবীন্দ্রনাথ 

আজ আমাদের এই নতুন করিয়া মহাজাগরণের দিনে আমাদের সেই শক্তিকে ভুলিলে চলিবে না- যাহাদের উপর আমাদের দশ আনা শক্তি নির্ভর করিতেছে, অথচ আমরা তাহাদিগকে উপেক্ষা করিয়া আসিতেছি। 

সেইহইতেছে, আমাদের দেশের তথাকথিত ‘ছােটলােক’ সম্প্রদায়। আমাদের আভিজাত্য-গর্বিত সম্প্রদায়ই এই হতভাগাদের এইরূপ নামকরণ করিয়াছেন। কিন্তু কোনাে যন্ত্র দিয়া এই দুই শ্রেণির লােকের অন্তর যদি দেখিতে পারাে, তাহা হইলে দেখিবে, ঐ তথাকথিত ‘ছােটলােক’-এর অন্তর কাচের ন্যায় স্বচ্ছ, এই ‘ছােটলােক’ এমন স্বচ্ছ অন্তর, এমন সরল মুক্ত উদার প্রাণ লইয়াও যে কোনাে কার্য করিতে পারিতেছে না, তাহার কারণ এই ভদ্র সম্প্রদায়ের অত্যাচার। 

সে বেচারা জন্ম হইতে এই ঘৃণা, উপেক্ষা পাইয়া নিজেকে এত ছােট মনে করে, সঙ্কোচ জড়তা তাহার স্বভাবের সঙ্গে এমন ওতপ্রােতভাবে জড়াইয়া যায় যে, সেও-যে আমাদেরই মতাে মানুষ- সেও যে সেই এক আল্লাহ্-এর সৃষ্টি, তাহারও যে মানুষ হইবার সমান অধিকার আছে, তাহা সে একেবারে ভুলিয়া যায়। 

উপেক্ষিত শক্তির উদ্বোধন | কাজী নজরুল ইসলামৎ

উপেক্ষিত শক্তির উদ্বোধন  কাজী নজরুল ইসলামৎ

যদি কেউ এই উৎপীড়নের বিরুদ্ধে বিদ্রোহাচরণ করে, অমনি আমাদের ভদ্র সম্প্রদায় তাহার মাথায় প্রচণ্ড আঘাত করিয়া তাহাকে অজ্ঞান করিয়া ফেলে। এই হতভাগাদিগকে আমাদের এই সত্যিকার মানুষদিগকে আমরা এই রকম অবহেলা ও করিয়া চলিয়াছি বলিয়াই আজ আমাদের এত অধঃপতন।

 তাই আমাদের দেশে জনশক্তি বা গণতন্ত্র গঠিতহইতে পারিতেছে না। হইবে কিরূপে? দেশের অধিবাসী লইয়াই তাে দেশ এবং ব্যক্তির সমষ্টিই তাে জাতি। আর সে-দেশকে, সে-জাতিকে যদি দেশের, জাতির সকলে বুঝিতে না পারে, তবে তাহার উন্নতির আশা করা আর আকাশে অট্টালিকা নির্মাণের চেষ্টা করা একই কথা। 

তােমরা ভদ্র সম্প্রদায়, মানি, দেশের দুর্দশা জাতির দুর্গতি বুঝাে, লােককে বুঝাইতে পারাে এবং ঐ দুর্ভাগ্যের কথা কহিয়া কাঁদাইতে পার, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে নামিয়া কার্য করিবার শক্তি তােমাদের আছে কি? না, নাই । এ-কথা যে নিরেট সত্য, তাহা তােমরাই বুঝে। 

কাজেই তােমাদের এই দেশকে, জাতিকে উন্নত করিবার আশা ঐ কথাতেই শেষ হইয়া যায়। কিন্তু যদি একবার আমাদের এই জনশক্তিকে উদ্বুদ্ধ করিতে পারাে, তাহাদিগকে মানুষ বলিয়া ভাই বলিয়া কোল দিবার তােমার উদারতা থাকে, 

তাহাদিগের শক্তির উন্মেষ করিতে পারাে, তাহা হইলে দেখিবে তুমি শত বৎসর ধরিয়া প্রাণপণে চেষ্টা সত্ত্বেও যে-কাজ করিতে পারিতেছ না, একদিনে সেই কাজ সম্পন্ন হইবে। একথা হয়তাে তােমার বিশ্বাস হইবে না, একবার মহাত্মা গান্ধীর কথা ভাবিয়া দেখাে দেখি! তিনি ভারতে কি অসাধ্য সাধন করিতে পারিয়াছেন!

তিনি যদি এমনি করিয়া প্রাণ খুলিয়া ইহাদের সহিত না মিশিতেন, ইহাদের সুখ-দুঃখের এমন করিয়া ভাগী না হইতেন, ইহাদিগকে যদি নিজের বুকের রক্ত দিয়া, তাহারা খাইতে পাইল না বলিয়া নিজেও তাহাদের সঙ্গে উপবাস করিয়া ইহাদিগকে নিতান্ত আপনার করিয়া না তুলিতেন, তাহা হইলে আজ তাঁহাকে কে মানিত? 

কে তাহার কথায় কর্ণপাত করিত? কে তাহার একটি ইঙ্গিতে এমন করিয়া বুক বাড়াইয়া মরিতে পারিত?

 তাঁহার আভিজাত্য-গৌরব নাই, পদ-গৌরবের অহঙ্কার নাই, অনায়াসে প্রাণের মুক্ত উদারতা লইয়া তােমাদের ঘৃণ্য এই ‘ছােটলােক’কে বক্ষে ধরিয়া ভাই বলিয়া ডাকিয়াছেন, সে-আহ্বানে জাতিভেদ নাই, ধর্মভেদ নাই, সমাজ-ভেদ নাই,-সে যে ডাকার মতাে ডাকা,-তাই নিখিল ভারতবাসী, এই উপেক্ষিত হতভাগারা তাঁহার দিকে এত হা হা করিয়া ব্যগ্র বাহু মেলিয়া ছুটিয়াছে। হায়, তাহাদের যে আর কেহ কখনাে এমন করিয়া এত বুকভরা স্নেহ দিয়া আহ্বান করেন নাই!

 এ মহা-আহ্বানে কি তাহারা সাড়া না দিয়া পারে? যদি পারাে, এমনি করিয়া ডাকো, এমনি করিয়া এই উপেক্ষিত শক্তির বােধন করাে- দেখিবে ইহারাই দেশে যুগান্তর আনিবে, অসাধ্য সাধন করিবে। ইহাদিগকে উপেক্ষা করিবার, মানুষকে মানুষ হইয়া ঘৃণা করিবার, তােমার কি অধিকার আছে? ইহা তাে আত্মার ধর্ম নয়।

 তাহার আত্মা তােমার আত্মার মতােই ভাস্বর, আর একই মহাআত্মার অংশ। তােমার জন্মগত অধিকারটাই কি এত বড়? তুমি যদি এই চণ্ডাল বংশে জন্মগ্রহণ করিতে, তাহা হইলে তােমার মতাে ভদ্রলােকদের দেওয়া এই সব হতাদর উপেক্ষার আঘাত, বেদনার নির্মমতা একবার কল্পনা করিয়া দেখাে দেখি,- ভাবিতে তােমার আত্মা কি শিহরিয়া উঠিবে না?

 আমাদের এই পতিত, চণ্ডাল, ছােটলােক ভাইদের বুকে করিয়া তাহাদিগকে আপন করিয়া লইতে, তাহাদেরই মতাে দীন বসন পরিয়া, তাহাদের প্রাণে তােমারও প্রাণ সংযােগ করিয়া উচ্চ শিরে তার সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াও, দেখিবে বিশ্ব তােমাকে নমস্কার করিবে। এস, আমাদের উপেক্ষিত ভাইদের হাত ধরিয়া আজ বােধন-বাঁশিতে সুর দিই

‘কিসের দুঃখ, কিসের দৈন্য,

 কিসের লজ্জা, কিসের ক্লেশ! ]

পাঠ-পরিচিতি: ‘উপেক্ষিত শক্তির উদ্বোধন’

পাঠ-পরিচিতি ‘উপেক্ষিত শক্তির উদ্বোধন’

শীর্ষক প্রবন্ধটি বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত নজরুল রচনাবলি (জন্মশতবর্ষ সংস্করণ, প্রথম খণ্ড) থেকে চয়ন করা হয়েছে। অবিভক্ত ভারতবর্ষের পটভূমিতে লেখা প্রবন্ধটি সম্পাদনা করে পাঠ্যভুক্ত করা হয়েছে। 

এটি কাজী নজরুল ইসলামের যুগবাণী” নামক প্রবন্ধ-গ্রন্থের একটি রচনা। আলােচ্য প্রবন্ধে কাজী নজরুল ইসলামের সাম্যবাদী মানসিকতার পরিচয় ফুটে উঠেছে। একটি দেশের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় ছােট-বড়, উঁচু-নিচু, ধর্মীয় ও জাতিগত বিভেদ দূর করা আবশ্যক। 

বিশ্বের বুকে মর্যাদাবান জাতি ও রাষ্ট্র গঠন করতে প্রতিটি দেশের মনীষীগণ আমরণ সংগ্রাম করে গেছেন। তাদের নির্দেশিত পথে যদি আমরা পরিভ্রমণ করতে পারি তবে আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে সুখ ও সমৃদ্ধি বিরাজ করবে।

লেখক-পরিচিতি : কাজী নজরুল ইসলাম

লেখক-পরিচিতি  কাজী নজরুল ইসলাম

১১ই জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬ সালে (২৪শে মে ১৮৯৯) ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসােল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ছেলেবেলায় তিনি লেটো গানের দলে যােগ দেন। পরে বর্ধমান ও ময়মনসিংহের ত্রিশাল থানার দরিরামপুর হাই স্কুলে লেখাপড়া করেন। 

১৯১৭ সালে তিনি সেনাবাহিনীর বাঙালি পল্টনে যােগ দিয়ে করাচি যান। সেখানেই তার সাহিত্য-জীবনের সূচনা ঘটে। তার লেখায় তিনি সামাজিক অবিচার ও পরাধীনতার বিরুদ্ধে সােচ্চার হয়েছেন। এজন্য তাঁকে ‘বিদ্রোহী কবি’ বলা হয়। 

বাংলা সাহিত্য জগতে তার আবির্ভাব এক নতুন দিগন্তের উন্মােচন করে। কবিতা, উপন্যাস, নাটক, ছােটগল্প, প্রবন্ধ ইত্যাদি সাহিত্যের সকল শাখায় তিনি প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। 

তিনি গজল, খেয়াল ও রাগপ্রধান গান রচনা করে খ্যাতি অর্জন করেন। আরবি-ফারসি শব্দের সার্থক ব্যবহার তাঁর কবিতাকে বিশিষ্টতা দান করেছে। মাত্র চল্লিশ বছর বয়সে কবি দুরারােগ্য রােগে আক্রান্ত হয়ে বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেন। 

বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর অসুস্থ কবিকে ঢাকায় আনা হয় এবং পরে তাঁকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করা হয়। তাঁকে স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় কবির মর্যাদায় ভূষিত করা হয়। তাঁর রচিত কাব্যগুলাের মধ্যে অগ্নিবীণা, বিষের বাঁশি, ছায়ানট, প্রলয়শিখা, চক্রবাক, সিন্ধুহিন্দোল বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য।

ব্যথার দান, রিক্তের বেদন, শিউলিমালা, মৃত্যুক্ষুধা, কুহেলিকা ইত্যাদি তাঁর রচিত গল্প ও উপন্যাস। যুগবাণী, দুর্দিনের যাত্রী ও রাজবন্দীর জবানবন্দী তাঁর উল্লেখযােগ্য প্রবন্ধগ্রন্থ। ২৯শে আগস্ট ১৯৭৬ সালে কবি ঢাকার পি.জি. হাসপাতালে (বর্তমান নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়) শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মসজিদ-সংলগ্ন প্রাঙ্গণে তাঁকে পরিপূর্ণ সামরিক মর্যাদায় সমাহিত করা হয়।]এই ধরনের আরও পোষ্ট পেতে আমাদের poramorso24.com নিয়মিত ভিজিট করুন । ধর্যসহকারে পড়ার জন্য ধন্যবাদ।

আরও পড়ুন

  1. আমাদের সংস্কৃতি: আনিসুজ্জামান
  2. আম-আঁটির ভেঁপু | বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
  3. শিক্ষা ও মনুষ্যত্ব কাকে বলে | মােতাহের হােসেন চৌধুরী
  4. লাইব্রেরি পরিচয় | মােতাহের হােসেন চৌধুরী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *