জলবায়ু পরিবর্তন ও কৃষিক্ষেত্রে প্রভাব: বাংলাদেশে ফসল উৎপাদনে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সৃষ্টির শুরু থেকেই পৃথিবীর জলবায়ু ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হয়ে প্রাণী ও উদ্ভিদের বসবাস উপযােগী হয়ে উঠে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের এ ধারা অত্যন্ত ধীর গতিতে অব্যাহত ছিল। কিন্তু বিগত এক শতকে পৃথিবীর অনেক দেশে জলবায়ুর উল্লেখযােগ্য পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে জলবায়ু পরিবর্তন প্রকৃতিতে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করছে।
এ পরিবর্তনের জন্য দায়ী উন্নত বিশ্ব । নগরায়ন, যান্ত্রিক সভ্যতা, কলকারখানার প্রসার, জ্বালানি তেল ও কয়লার যথেচ্ছ ব্যবহার, বৃক্ষনিধন ইত্যাদির কারণে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউস গ্যাসের পরিমাণ বাড়ছে। ফলে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশে পরিবর্তনের কারণে আজ বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ও বিপদাপন্ন দেশ বলে চিহ্নিত হয়েছে ।
জলবায়ু পরিবর্তন ও কৃষিক্ষেত্রে প্রভাব
জাতিসংঘের মানব উন্নয়ন রিপাের্টে (২০০৭-০৮) বলা হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের ৭ কোটি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ভৌগলিক অবস্থান এবং ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের কারণে বাংলাদেশ আগে থেকেই পৃথিবীর একটি অন্যতম দুর্যোগপ্রবণ দেশ। বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব দুর্যোগের মাত্রাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। IPCC (Intergovernmental Panel on Climate Change) সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে-
- ১। বাংলাদেশের গড় বার্ষিক তাপমাত্রা ১৯৮৫-১৯৯৮ সালের মধ্যে মে মাসে ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং নভেম্বর মাসে ০.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেয়েছে।
- ২। বাংলাদেশের ৮ লাখ ৩০ হাজার হেক্টর জমিতে লবণাক্ততা দেখা দিয়েছে ।
- ৩। বাংলাদেশের গড় বৃষ্টিপাত বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ২০০২, ২০০৩, ২০০৪ ও ২০০৭ সালে বন্যা হয়েছে অর্থাৎ ভয়াবহ বন্যার সংখ্যা বেড়েছে।
- ৪। বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা বেড়েছে।
- ৫। গ্রীষ্মকালে সমুদ্রের লােনা পানি নদীপথে দেশের অভ্যন্তরে প্রায় ১০০ কিলােমিটার পর্যন্ত প্রবেশ করেছে।
দেশের পরিবেশ ও উৎপাদন প্রেক্ষাপটসমূহ বিবেচনায় জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ও ঝুঁকিপূর্ণ খাত হচ্ছে কৃষি খাত। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে দেশে বিভিন্ন রকম বিরূপ অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে; যেমন
- ১। গ্রীষ্মকালে অতি উচ্চ তাপমাত্রা
- ২। অনিয়মিত ও অসময়ে বৃষ্টিপাত
- ৩। অল্প সময়ে অধিক বৃষ্টি এবং তার ফলে জলাবদ্ধতা ও ভূমিধস
- ৪। শুষ্ক মৌসুমে কম বৃষ্টিপাত
- ৫। বন্যার ভয়াবহতা ও সংখ্যা বৃদ্ধি
- ৬। আকস্মিক বন্যা ও খরার ফলে ফসলহানি
- ৭। অতিরিক্ত ঠাণ্ডা ও গরম।
- ৮। উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ত জমির পরিমাণ বৃদ্ধি ও ভূমিক্ষয়
- ৯। ঝড়-জলােচ্ছ্বাসের তীব্রতা ও সংখ্যা বৃদ্ধি
- ১০। কুয়াশা, শিলাবৃষ্টি ইত্যাদি
ফসল উৎপাদনে তাপমাত্রার প্রভাব
আমরা আগেই জেনেছি জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশে গ্রীষ্মকাল ও শীতকালে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। পাশাপাশি গ্রীষ্ম ও শীতকালে তাপমাত্রার হ্রাস-বৃদ্ধির অস্বাভাবিক আচরণ লক্ষ করা যাচ্ছে। কখনাে কখনাে গ্রীষ্মকালে অতি উচ্চ তাপমাত্রা এবং শীতকালে অত্যাধিক শীত পড়তে দেখা যাচ্ছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশে উফশী ধানের ফলন কমে যাবে এবং গমে রােগের আক্রমণ বেড়ে যাবে।
এখনকার চেয়ে দেশের তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেলে গম চাষ সম্ভব হবে না। আলু ও অন্যান্য শীতকালীন ফসল উৎপাদনে ধস নামবে । ধানের জন্য অসহ্য গরম তাপমাত্রা হলাে ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ফুল ফোটার সময় ধানগাছ সবচেয়ে বেশি কাতর ।
এ সময় তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তারও বেশি হলে চিটার পরিমাণ বেড়ে যায়। নিম্ন তাপমাত্রার কারণে ধানগাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়, ধানগাছ হলদে বর্ণ ধারণ করে, ধানের চারা দুর্বল হয় এবং ফসলের জীবনকাল বেড়ে যায়।
ফসল উৎপাদনে খরার প্রভাব
বাংলাদেশে ফসল উৎপাদনে খরা অন্যতম একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যা দিন দিন প্রকট আকার ধারণ করছে। ফসলের বৃদ্ধি পর্যায়ে গড় বৃষ্টিপাতের অভাবে মাটিতে পানি শূন্যতা সৃষ্টি হয়। কম বৃষ্টিপাত ও অধিক হারে মাটি থেকে পানি বাষ্পীভূত হওয়ার ফলে কৃষিক্ষেত্রে খরার প্রভাব দেখা দেয়। দেশে প্রতি বছর ৩০-৪০ লাখ হেক্টর জমি বিভিন্ন মাত্রার খরায় কবলিত হয়ে থাকে। খরাপ্রবণ এলাকায় ফসলের ফলন নির্ভর করে খরার তীব্রতা, খরার স্থিতিকাল এবং ফসলের বৃদ্ধি পর্যায়ের উপর । ফসলে ক্ষতির মাত্রার উপর নির্ভর করে খরাকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়; যেমন
১। তীব্র খরা (৭০-৯০ ভাগ ফলন ঘাটতি হয়)
২। মাঝারি খরা (৪০-৭০ ভাগ ফলন ঘাটতি হয়)
৩। সাধারণ খরা (১৫-৪০ ভাগ ফলন ঘাটতি হয়)
ফসল উৎপাদন মৌসুমের উপর ভিত্তি করে খরাকে আবার তিন ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন- রবি খরা, খরিপ-১ খরা ও খরিপ-২ খরা ।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে খরার তীব্রতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, দিনাজপুর, বগুড়া, কুষ্টিয়া, যশাের, ঢাকা ও টাঙ্গাইল জেলার কিছু অংশে তীব্র খরা প্রবণ এলাকা। রংপুর ও বরিশাল জেলা এবং দিনাজপুর, কুষ্টিয়া ও যশাের জেলার কিছু অংশ মাঝারি খরাপ্রবণ এলাকা।
তবে বর্তমানে তিস্তা নদীতে পানিপ্রবাহ হ্রাস পাওয়ায় শুষ্ক মৌসুমে তিস্তা অববাহিকায় খরার তীব্রতা বৃদ্ধি পেয়েছে। খরাতে খাপ খাওয়ানাের কৌশল হিসাবে চাষ পদ্ধতির পরিবর্তন, কম পানি লাগে এমন ফসলের চাষ, জাবড়া প্রয়ােগ ইত্যাদি পদ্ধতিকে উৎসাহিত করে উপযােগী ফসলের চাষ করতে হবে। খরা সহিষ্ণু স্থানীয় জাতের উন্নয়ন ও এর আবাদ এলাকা বাড়াতে হবে।
খরার কারণে ধান লাগাতে বেশি দেরি হলে নাবি ও খরা সহিষ্ণু জাতের ধান চাষ করতে হবে। আমন ধান কাটার পর খরা সহনশীল ফসল যেমন— ছােলা চাষ, তেল ফসল হিসাবে তিলের চাষ জনপ্রিয় করতে হবে।
এই ধরনের আরও পোষ্ট পেতে আমাদের poramorso24.com নিয়মিত ভিজিট করুন । ধর্যসহকারে পড়ার জন্য ধন্যবাদ। বেলি ফুল চাষ পদ্ধতি ও রােগ বালাই ব্যবস্থাপনা
আরও পড়ুন