আদর্শ পুকুরের বৈশিষ্ট্য গুণাগুণ ও প্রয়োজনীতা

আদর্শ পুকুরের বৈশিষ্ট্য গুণাগুণ ও প্রয়োজনীতা

আদর্শ পুকুরের বৈশিষ্ট্য গুণাগুণ ও প্রয়োজনীতা: পুকুর হচ্ছে ছােট ও অগভীর বদ্ধ জলাশয়, যেখানে নিয়ন্ত্রিত উপায়ে মাছ চাষ করা যায় এবং প্রয়ােজনে এটিকে সহজেই সম্পূর্ণভাবে শুকিয়ে ফেলা যায়। এক কথায় পুকুর হচ্ছে চাষযােগ্য মাছের বাসস্থান। পুকুরে পানি স্থির অবস্থায় থাকে। 

আদর্শ পুকুরের বৈশিষ্ট্য গুণাগুণ ও প্রয়োজনীতা

তবে বাতাসের প্রভাবে এতে অল্প ঢেউ সৃষ্টি হতে পারে। পুকুরের আয়তন কয়েক শতাংশ থেকে কয়েক একর হতে পারে। তবে ছােট ও মাঝারি আকারের পুকুর ব্যবস্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সুবিধাজনক এবং এই ধরনের পুকুর অধিকতর উৎপাদনশীল হয়।

আদর্শ পুকুরের বৈশিষ্ট্য 

মাছ চাষের পুকুরের কিছু বৈশিষ্ট্য থাকা দরকার যা চাষ প্রক্রিয়াকে লাভজনক করতে যথেষ্ট ভূমিকা রাখে। একটি আদর্শ মাছ চাষের পুকুরের নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্যগুলাে থাকা প্রয়ােজন-

  • ১। পুকুরটি বন্যামুক্ত হবে। এজন্য পুকুরের পাড় যথেষ্ট উঁচু হতে হবে । 
  • ২। পুকুরের মাটি দোআঁশ, পলি- দোআঁশ বা এঁটেল দোআঁশ হলে সবচেয়ে ভালাে। 
  • ৩। সারা বছর পানি থাকে এমন পুকুর চাষের জন্য অধিক উপযুক্ত। 
  • ৪। পুকুরের পানির গভীরতা ০.৭৫-২ মিটার সুবিধাজনক। 
  • ৫। পুকুরটি খােলামেলা স্থানে হলে ভালাে হয় এবং পাড়ে কোনাে বড় গাছপালা না লাগালে ভালাে হয় । এতে পুকুর প্রচুর আলাে-বাতাস পাবে। ফলে পুকুরে সালােকসংশ্লেষণ বেশি হবে ও মাছের খাদ্য বেশি তৈরি হবে। পানিতে পর্যাপ্ত অক্সিজেন মিশবে। উত্তর-দক্ষিণমুখী পুকুর সূর্যালােক বেশি পাবে। 
  • ৬। পুকুরের তলায় অতিরিক্ত কাদা থাকা উচিত নয়। তলার কাদার পুরুত্ব ২০-২৫ সেমি এর বেশি হওয়া ঠিক নয়। 
  • ৭। চাষের পুকুরের আয়তন ২০-২৫ শতক হলে ব্যবস্থাপনা সহজ হয় । পুকুরের আকৃতি আয়তাকার হলে ভালাে। এতে করে জাল টেনে মাছ আহরণ করা সহজ হয়। 
  • ৮। পুকুরের পাড়গুলাে ১:২ হারে ঢালু হলে সবচেয়ে ভালাে। অর্থাৎ পুকুরের তলা হতে পুকুরের পাড় যতটুকু উঁচু হবে পাড় ঢালু হয়ে পুকুরের তলার দিকে দ্বিগুণ দূরত্বে গিয়ে মিশবে। 

মাছ চাষের পুকুরের পানির গুণাগুণ 

মাছের বেঁচে থাকা, খাদ্যগ্রহণ ও আশানুরূপ বৃদ্ধির জন্য পুকুরের পানির গুণাগুণ অনুকূল মাত্রায় থাকা দরকার। পুকুরে পানির গুণাগুণকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। 

  • ১) ভৌত গুণাগুণ 
  • ২) রাসায়নিক গুণাগুণ । 

মাছ চাষে এদের প্রভাব সংক্ষেপে আলােচনা করা হলাে-

১। ভৌত গুণাগুণ 

ক) গভীরতা: 

পুকুর বেশি গভীর হলে সূর্যের আলাে পুকুরের অধিক গভীরতা পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে না।

ফলে অধিক গভীর অঞ্চলে মাছের প্রাকৃতিক খাদ্য প্লাংকটন তৈরি হয় না। আবার সেখানে অক্সিজেনের অভাব হতে পারে। অন্যদিকে পুকুর অগভীর হলে গ্রীষ্মকালে পুকুরের পানি অতিরিক্ত গরম হয়ে যায়। এসব কারণে মাছের ক্ষতি হতে পারে ও উৎপাদন ব্যাহত হতে পারে। 

খ) তাপমাত্রা: 

তাপমাত্রার বৃদ্ধির উপর মাছের বৃদ্ধি নির্ভর করে। যেমন- শীতকালে মাছ খাদ্য গ্রহণ কমিয়ে

দেয় ফলে মাছের বৃদ্ধি কমে যায়।এ কারণে শীতকালে পুকুরে সার ও খাদ্য প্রয়ােগের পরিমাণ কমিয়ে দিতে হয়। রুই জাতীয় মাছের বৃদ্ধি ২৫-৩০° সে. তাপমাত্রা সবচেয়ে ভালাে হয়। 

গ) ঘােলাত্ব: 

কাদা কণার কারণে পুকুরের পানি ঘােলা হলে পানিতে সূর্যালােক প্রবেশে বাধা পায়। এতে

করে মাছের প্রাকৃতিক খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হয়।

ঘ) সূর্যালোেক 

যে পুকুরে সূর্যালােক বেশি পড়ে সেখানে সালােকসংশ্লেষণ ভালাে হয়। ফলে সেখানে ফাইটোপ্লাংটন বেশি উৎপাদিত হয় ও মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। 

২। রাসায়নিক গুণাগুণ 

ক) দ্রবীভূত অক্সিজেন: 

পুকুরের পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন মাছ চাষের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রধানত ফাইটোপ্লাংকটন ও জলজ উদ্ভিদ সালােকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় অক্সিজেন তৈরি করে পুকুরের পানিতে দ্রবীভূত হয়। বায়ুমণ্ডল হতে সরাসরি পানির উপরিভাগেও কিছু অক্সিজেন মিশ্রিত হয়। পুকুরে বসবাসকারী মাছ, জলজ উদ্ভিদ ও অন্যান্য প্রাণী এ অক্সিজেন দ্বারা শ্বাসকার্য চালায়। রাতে সূর্যালােকের অভাবে সালােকসংশ্লেষণ হয় না বলে পানিতে কোনাে অক্সিজেন তৈরি হয় না। এজন্য সকালে পুকুরে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যায় ও বিকেলে বেশি থাকে। মাছ চাষের জন্য পুকুরের পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ কমপক্ষে ৫ মিলি গ্রাম/লিটার (৫ পিপিএম বা ১ মিলিয়ন ভাগের পাঁচ ভাগ) থাকা প্রয়ােজন। 

খ) দ্রবীভূত কার্বন ডাইঅক্সাইডঃ 

পুকুরে মাছের প্রাকৃতিক খাদ্য ফাইটোপ্লাংকটনের উৎপাদনের জন্য পর্যাপ্ত

দ্রবীভূত কার্বন ডাইঅক্সাইড থাকা প্রয়ােজন। তবে মাত্রাতিরিক্ত কার্বন ডাইঅক্সাইড মাছের জন্য ক্ষতিকর। পানিতে কার্বন ডাইঅক্সাইডের মাত্রা ১২ মিলি গ্রাম/লিটারের (১২ পিপিএম) নিচে থাকলে তা মাছ ও চিংড়ির জন্য বিষাক্ত নয়। মাছের ভালাে উৎপাদন পাওয়ার জন্য পুকুরের পানিতে ১-২ পিপিএম কার্বন ডাইঅক্সাইড থাকা প্রয়ােজন। 

গ) পিএইচ (PH): 

পুকুরের পানির pH মান নির্ণয় করে অম্লত্ব বা ক্ষারত্বের মাত্রা বােঝা যায়। মাছ চাষের

জন্য পুকুরের পানির PH ৬.৫ হতে ৮.৫ এর মধ্যে হলে ভালাে হয় । PH ৪ এর নিচে বা ১১ এর উপরে হলে মাছ মারা যায়। পানির PH কমে অশ্লীয় হয়ে গেলে পুকুরে চুন (১-২ কেজি/শতক) প্রয়ােগ করতে হবে। পুকুরে PH বেড়ে ক্ষারীয় অবস্থা বেশি বেড়ে গেলে এমােনিয়াম সালফেট বা তেতুল পানিতে গুলে পুকুরে প্রয়ােগ করা যেতে পারে । 

ঘ) ফসফরাস: 

প্রাকৃতিক পানিতে অতি অল্প পরিমাণ ফসফরাস থাকে। এই ফসফরাস ফসফেটে

রূপান্তরিত হয়। পরিমিত ফসফেটের উপস্থিতিতে প্রচুর পরিমাণ ফাইটোপ্লাংটন জন্মায়।

মাছের প্রজাতির নির্বাচন : 

যেহেতু ধানক্ষেতে খুব বেশি পানি থাকে না তাই কম পানিতে ও কম অক্সিজেনে বাঁচতে পারে, উচ্চ তাপমাত্রা সহ্য করতে পারে এবং সেইসাথে ধান চাষকালীন সময়ের মধ্যে খাওয়ার উপযােগী হয় এরূপ দ্রুত বর্ধনশীল মাছ নির্বাচন করতে হবে, যেমন- কার্পিও, সরপুঁটি, তেলাপিয়া। তবে এগুলাের সাথে অল্পসংখ্যক রুই, কাতলা দেওয়া যেতে পারে। আবার মাগুর মাছের পােনাও ছাড়া যায়। তবে গ্রাস কার্প ছাড়া যাবে না কারণ এরা ধান গাছ খেয়ে ফেলতে পারে।

 পােনা মজুদ :

ধান রােপণের ১০-১৫ দিন পর যখন ধান গাছ শক্তভাবে মাটিতে লেগে যাবে তখন চিংড়ি ও মাছ মজুদ করতে হবে। শতাংশ প্রতি মাছের পােনা ১৫-২০টি ও চিংড়ির পােনা ৪০-৫০টি মজুদ করা যেতে পারে। 

সম্পূরক খাদ্য তৈরি ও প্রয়ােগ : 

চালের কুঁড়া, খৈল, ফিশমিল ১ঃ১ঃ১ অনুপাতে নিয়ে এর সাথে প্রয়ােজনীয় পরিমাণ আটা পানিতে ফুটিয়ে আঠালাে করে উক্ত উপকরণগুলাের সাথে মিশিয়ে কাই করে ছােট ছােট বল বানিয়ে মাছ ও চিংড়িকে সরবরাহ করতে হবে। প্রতিদিন দেহের ওজনের ৩-৫% খাবার তিন ভাগ করে সকাল, দুপুর ও সন্ধ্যায় প্রয়ােগ করতে হবে। 

ব্যবস্থাপনা : 

ধানের সাথে মাছ চাষ করলে কীটনাশক দেওয়া উচিত নয়। তবে কীটনাশক ব্যবহার অত্যাবশ্যক হলে ক্ষেতের পানি কমিয়ে মাছকে ডােবা/নালায় আটকিয়ে তা করতে হবে। কীটনাশক ব্যবহারের অন্তত ৫ দিন পর সেচ দিয়ে পুনরায় মাছকে সমস্ত জমিতে চলাচলের সুযােগ করে দিতে হবে। ক্ষেতের পানি কমে গেলে দ্রুত সেচের ব্যবস্থা করতে হবে। মাছে রােগ বালাই এর লক্ষণ দেখা দিলে মাছগুলােকে ডােবার মধ্যে নিয়ে শতক প্রতি ১ কেজি চুন প্রয়ােগ করতে হবে। 

ধান, মাছ ও চিংড়ি আহরণ :

ধান কাটার সময় হলে ক্ষেতের পানি কমিয়ে চিংড়ি ও মাছগুলােকে নালা বা ডােবায় এনে ধান কাটতে হবে । ধান কাটার পরও যদি ক্ষেতে পানি থাকে বা পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করা যায় তাহলে পরবর্তী ফসল শুরু করার পূর্ব পর্যন্ত মাছ চাষ চালিয়ে নেওয়া যেতে পারে।

আরও পড়ুন : আনারস চাষ পদ্ধতি