বাংলাদেশের স্থানীয় সরকারব্যবস্থা: রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থার সুষ্ঠু পরিচালনার জন্য কেন্দ্রীয় প্রশাসনের পাশাপাশি স্থানীয় শাসনব্যবস্থা গড়ে উঠে। স্থানীয় পর্যায়ের সমস্যা সমাধানের জন্য তৃণমূল পর্যায়ে এই ধরনের সরকার গড়ে উঠে। বাংলাদেশে এই ধরনের স্থানীয় সরকারব্যবস্থা বিদ্যমান। স্থানীয় সরকারব্যবস্থায় জনগণ রাষ্ট্রের শাসনকার্যে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণের সুযােগ পায় । তাই স্থানীয় শাসন গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থার অপরিহার্য অংশ।
বাংলাদেশের স্থানীয় সরকারব্যবস্থা
স্থানীয় সরকার
স্থানীয় সরকার হচ্ছে সমগ্র রাষ্ট্রকে বিভিন্ন অঞ্চলে বিভক্ত করে ক্ষুদ্রতর পরিসরে প্রতিষ্ঠিত সরকারব্যবস্থা। কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে সম্পর্কের ভিত্তিতে স্থানীয় সরকারের রূপ দুই ধরনের হয়। যেমন :
১। স্থানীয় সরকার ও
২। স্থানীয় স্বায়ত্বশাসিত সরকার।
স্থানীয় প্রশাসন হচ্ছে সেই প্রশাসন যেখানে প্রশাসককে কেন্দ্রীয় সরকার নিয়ােগ দেয় এবং কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশ বাস্তবায়নই এর প্রধান কাজ। বিভাগ, জেলা, উপজেলা পর্যায়ে প্রশাসনিক কর্মকর্তা এবং ইউনিয়ন পর্যায়ে সচিব সরকার কর্তৃক নিযুক্ত হন। স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকার বলতে বুঝায় এমন ধরনের সরকারব্যবস্থা যা ছােট ছােট এলাকায় স্থানীয় প্রয়ােজন মেটাবার জন্য জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা গঠিত ও আইনের মাধ্যমে ক্ষমতাপ্রাপ্ত সংস্থা।
আমাদের দেশে ইউনিয়ন পরিষদ, জেলা পরিষদ, উপজেলা, পৌরসভা ও সিটি কর্পোরেশন স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকারের উদাহরণ। স্থানীয় প্রশাসন আবার স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকারের সহযােগী হিসাবে কাজ করে।
স্থানীয় সরকারের গুরুত্ব
ব্রিটিশ রাজনৈতিক দার্শনিক জন স্টুয়ার্ট মিলের মতে, স্থানীয় সরকার সরকারি ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জনগণের অংশগ্রহণের সুযােগ সৃষ্টি করে এবং এ বিষয়ে নাগরিকদেরকে সচেতন করে।
স্থানীয় সরকার স্থানীয় পর্যায়ে নাগরিকদেরকে যথাযথভাবে বিভিন্ন সেবা প্রদান করতে পারে। কেন্দ্রীয় প্রশাসকদের পক্ষে সঠিক ভাবে স্থানীয় জনগণের স্বার্থরক্ষা, তাদের সমস্যা সমাধান করা এবং স্থানীয় উন্নয়ন সংক্রান্ত বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা অর্জন করা সম্ভব হয় না।
এ ক্ষেত্রে তাদেরকে স্থানীয় সরকারের উপর নির্ভর করতে হয়। স্থানীয় সরকার এ সকল বিষয়ে তথ্য সরবরাহের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকারকে যথাযথ নীতিমালা ও গ্রহণ ও উন্নয়ন কর্মকান্ড বাস্তবায়নে সহায়তা করে।
বাংলাদেশের স্থানীয় সরকারব্যবস্থার স্বরূপ
বাংলাদেশের স্থানীয় সরকারব্যবস্থার দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। মুঘল আমল থেকে শুরু হয়ে ব্রিটিশ শাসন পর্যন্ত নানা আইনি সংস্কারের মধ্য দিয়ে এদেশে স্থানীয় সরকারের শাসন-কাঠামাে রূপ লাভ করে। পাকিস্তানি শাসন আমলে এর প্রকৃতি অপরিবর্তিত থাকে। ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর নতুন রাষ্ট্রের সবকিছুই ঢেলে সাজানাের প্রয়ােজন হয়।
নতুন রাষ্ট্রে ১৯৭২-এর সংবিধানে স্থানীয় সরকারব্যবস্থার উপর বিশেষ গুরুত্বারােপ করা হয়। বাংলাদেশে বর্তমানে তিন স্তরবিশিষ্ট স্থানীয় সরকার কাঠামাে লক্ষ করা যায় । যথা- ইউনিয়ন পরিষদ, থানা/ উপজেলা পরিষদ ও জেলা পরিষদ। এছাড়া শহরগুলােতে পৌরসভা, ১১টি বড় শহরে সিটি কর্পোরেশন, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলায় তিনটি (খাগড়াছড়ি, বান্দরবান, রাঙামাটি) স্থানীয় জেলা পরিষদ রয়েছে। উল্লিখিত তিন স্তরের মধ্যে ইউনিয়ন পরিষদকেই নিচের দিকে সবচেয়ে কার্যকর ইউনিট বলে মনে করা হয়ে থাকে। বাংলাদেশের স্থানীয় সরকারব্যবস্থাG
গ্রাম বা এর নিকটবর্তী হচ্ছে ইউনিয়ন ও উপজেলা পরিষদ। শহর এলাকায় রয়েছে পৌরসভা, জেলা পরিষদ ও সিটি কর্পোরেশন। এছাড়া পার্বত্য এলাকার জন্য বিশেষ স্থানীয় সরকারের ব্যবস্থা রয়েছে।
ইউনিয়ন পরিষদ
গঠন
গড়ে ১০-১৫টি গ্রাম নিয়ে একটি ইউনিয়ন পরিষদ গঠিত। এর একজন নির্বাচিত চেয়ারম্যান, ৯ টি ওয়ার্ড থেকে নয়জন নির্বাচিত সাধারণ সদস্য ও তিনজন নির্বাচিত মহিলা সদস্য (সংরক্ষিত আসনে) রয়েছেন। একটি ইউনিয়ন ৯টি ওয়ার্ডে বিভক্ত।
মহিলা সদস্যগণ প্রতি ৩ ওয়ার্ডে ১ জন-এই ভিত্তিতে জনগণের সরাসরি ভােটে নির্বাচিত হন। ইউনিয়ন পরিষদে একজন বেতনভুক্ত সচিব থাকে । ইউনিয়ন পরিষদের কার্যকাল ৫ বছর। তবে মেয়াদ পূর্তির পূর্বেও দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের অনাস্থা ভােটের মাধ্যমে চেয়ারম্যান ও অন্য যেকোনাে সদস্যকে অপসারণ করা যায়। বাংলাদেশে সর্বমােট ৪৪৫৩ টি ইউনিয়ন পরিষদ রয়েছে।
কার্যাবলি
ইউনিয়ন পরিষদ গ্রামীণ জীবনে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। গ্রামীণ সমস্যা দূরীকরণ, গণসচেতনতা বৃদ্ধি ও দায়িত্বশীল নেতৃত্ব তৈরি করার লক্ষ্যে ইউনিয়ন পরিষদ অনেক কাজ করে । নিমে সেগুলাে আলােচনা করা হলাে :
১. ইউনিয়ন পরিষদ রাস্তাঘাট, সেতু, কালভার্ট নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ এবং রাস্তার ধারে বৃক্ষরােপণ করে।
২. কৃষি উন্নয়নের জন্য ইউনিয়ন পরিষদ উন্নতমানের বীজ, সার ও কীটনাশক সরবরাহ ও অধিক খাদ্য উৎপাদনে উৎসাহ প্রদান করে।
৩. মৎস্য চাষ, পশুপালন ও পশুসম্পদ উন্নয়নের জন্য প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে।
৪. জনস্বাস্থ্য রক্ষার জন্য ইউনিয়ন পরিষদ পরিবেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার ব্যবস্থা করে। ময়লা আবর্জনা ফেলা, প্রাণী জবাই, গবাদি পশুর গােসল, ময়লা কাপড়-চোপড় ধােয়া ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করে।
৫. প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য দাতব্য হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করে।
৬. ইউনিয়ন পরিষদ জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে গণসচেতনতা তৈরি করে এবং জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রয়ােজনীয় উপকরণ অল্প খরচে সহজে পাওয়ার ব্যবস্থা করে ।
৭. শিক্ষা বিস্তার ও নিরক্ষরতা দূরীকরণের জন্য ইউনিয়ন পরিষদ দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের বৃত্তি প্রদান, বয়স্ক শিক্ষাদান কেন্দ্র ও লাইব্রেরি স্থাপন ইত্যাদি করে।
৮. জনগণের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য কুটির শিল্প স্থাপন ও সমবায় আন্দোলন পরিচালনা করে এবং এ ব্যাপারে জনগণকে উৎসাহিত করে।
৯. ইউনিয়ন পরিষদ নিজ অফিসের ব্যয় নির্বাহের জন্য বিভিন্ন ধরনের কর ধার্য ও আদায় করে এবং বিভিন্ন ধরনের রাজস্ব সংগ্রহে সরকারকে সহায়তা করে।
১০. ইউনিয়ন পরিষদ জন্ম-মৃত্যু ও বিবাহ রেজিস্টার রক্ষণাবেক্ষণ করে ।
১১. বন্যা ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় ইউনিয়ন পরিষদ দুস্থদের সাহায্য ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করে ।
১২. ইউনিয়ন পরিষদ গ্রামীণ জীবনের বিভিন্ন বিরােধ নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করে। সর্বোচ্চ পাঁচ (০৫) হাজার | টাকা দাবির দেওয়ানি ও ছােটখাটো ফৌজদারি মামলার বিচার ইউনিয়ন পরিষদ করতে পারে।
আয়ের উৎস
ইউনিয়ন পরিষদের আয়ের উৎস :
ক. বাড়িঘর, দালান-কোঠার উপর কর
খ. জন্ম, বিবাহ ও ভােজের উপর ফি
গ. সিনেমা, থিয়েটার, যাত্রা, সার্কাস, মেলা ইত্যাদির উপর কর
ঘ. যানবাহনের উপর কর
ঙ. লাইসেন্স, পারমিট ফি
চ. জনস্বার্থে বিশেষ কল্যাণকর কাজের জন্য ফি ছ. হাট বাজার, জলমহাল, ফেরিঘাট ইজারা ও টোল সংগ্রহ
জ, সরকার কর্তৃক প্রদত্ত বরাদ্দ/অনুদান ইত্যাদি।
উপজেলা পরিষদ
আমাদের দেশে থানা/উপজেলা একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক স্তর।
গঠন
একজন চেয়ারম্যান, দুজন ভাইস চেয়ারম্যান (এদের মধ্যে একজন হবেন মহিলা) এবং উপজেলার আওতাধীন ইউনিয়ন পরিষদসমূহের চেয়ারম্যানবৃন্দ, পৌরসভার (যদি থাকে) মেয়র এবং তিনজন মহিলা সদস্যের সমন্বয়ে উপজেলা পরিষদ গঠিত হয়। বাংলাদেশের স্থানীয় সরকারব্যবস্থাG
২০০৯ সালের উপজেলা পরিষদ আইন অনুযায়ী সংসদ সদস্যদেরকে পরিষদের পরামর্শকের ভূমিকা প্রদান করা হয়েছে । চেয়ারম্যান উপজেলার ভােটারদের প্রত্যক্ষ ভােটে নির্বাচিত হন।
ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও পৌরসভার (যদি থাকে) মেয়রবৃন্দ পদাধিকারবলে এর সদস্য হবেন । ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভার (যদি থাকে) নির্বাচিত মহিলা সদস্যদের ভােটে তাদের মধ্য থেকে তিনজন মহিলা সদস্য নির্বাচিত হবেন। উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) পরিষদের নির্বাহী কর্মকর্তা বা সচিবের দায়িত্ব পালন করবেন। পরিষদের কার্যকাল হবে ৫ বছর । বর্তমানে বাংলাদেশে , ৪৯০টি উপজেলা রয়েছে।
কার্যাবলি
উপজেলা পরিষদের কাজগুলাে নিচে আলােচনা করা হলাে:
১. ইউনিয়ন পরিষদের উন্নয়ন কার্যক্রমের সমন্বয়সাধন করে।
যােগাযােগ ও ভৌত অবকাঠামাে উন্নয়নের জন্য আন্তঃইউনিয়ন সংযােগকারী রাস্তা নির্মাণ, মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ করে ।
৩, মহিলা ও শিশু উন্নয়ন, সমাজকল্যাণ, যুব, ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নে সহায়তা দান করে।
৪. কৃষি উন্নয়নের লক্ষ্যে পশু পালন, মৎস্য চাষ, বনজ সম্পদ উন্নয়ন ও সেচ প্রকল্প গ্রহণসহ বিভিন্ন উন্নয়ন কার্যক্রম গ্রহণ করে।
৫. নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরােধে জনমত গঠনসহ প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে ।
৬. প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়নের লক্ষ্যে সামাজিক বনায়ন কার্যক্রম গ্রহণ করে।
৭. ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প স্থাপন ও বিকাশের জন্য কার্যক্রম গ্রহণ করে।
৮. শিক্ষা প্রসারের জন্য মাধ্যমিক ও মাদ্রাসা শিক্ষা কার্যক্রমের মান উন্নয়নের জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলাের কার্যক্রম তদারক করে ।
৯. নিরাপদ খাবার পানি সরবরাহ ও পয়নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন নিশ্চিত করে।
১০. উপজেলা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নসহ পুলিশ বিভাগের কার্যক্রম আলােচনা করে।
১১. আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টি ও দারিদ্র্য বিমােচনের লক্ষ্যে কর্মসূচি গ্রহণ করে।
১২. সরকার কর্তৃক প্রদত্ত অন্যান্য কার্যক্রম সম্পাদন করে ।
আয়ের উৎস
উপজেলা পরিষদ কর্তৃক ধার্যকৃত কর, টোল, ফি এবং সরকার ও অন্যান্য উৎস থেকে প্রাপ্ত অর্থ বা অনুদান ইত্যাদি নিয়ে উপজেলা পরিষদের তহবিল গঠিত হবে ।
জেলা পরিষদ
জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জেলার জনগণ দ্বারা সরাসরি নির্বাচনের বিধান রাখা হয়। জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান একজন প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদার অধিকারী এবং জেলা প্রশাসককে তার অধীনে প্রধান নির্বাহী করা হয়।
সংসদ সদস্য এই পরিষদে পরামর্শকের ভূমিকা পালন করেন। তবে বর্তমানে সরকার জেলা পরিষদে নির্বাচিত চেয়ারম্যানের বদলে একজন করে প্রশাসক নিয়ােগ দিয়েছেন।
গঠন
২০০০ সালের জেলা পরিষদ আইন অনুযায়ী জেলা পরিষদ গঠিত হবে একজন চেয়ারম্যান, পনেরজন সদস্য এবং সংরক্ষিত আসনে ৫ জন মহিলা সদস্য নিয়ে। এরা সবাই একটি নির্দিষ্ট জেলার অধীন সিটি কর্পোরেশনের মেয়র, কমিশনারবৃন্দ, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এবং সদস্যদের ভােটে নির্বাচিত হবেন। এই পরিষদের মেয়াদ হবে পাঁচ বছর।
কার্যাবলি
২০০০ সালের আইনের অধীনে জেলা পরিষদকে ১২টি বাধ্যতামূলক এবং ৬৮টি ঐচ্ছিক কার্যাবলির দায়িত্ব দেওয়া হয়। জেলা পরিষদের উল্লেখযােগ্য কাজের মধ্যে রয়েছে পরিকল্পনা এবং উন্নয়ন, শিল্প এবং বাণিজ্যের উন্নয়ন, সরকারি হাসপাতাল তত্ত্বাবধান, পারিবারিক ক্লিনিক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন।
সেই সাথে আন্তঃজেলা সড়ক প্রকল্প প্রস্তুতকরণ এবং চলমান পুলিশি কর্মকাণ্ডের তত্ত্বাবধান, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নয়নে সহায়তা, সন্ত্রাস দমনে সুপারিশ এবং উপজেলা কর্মকাণ্ডের তদারক। জেলা পরিষদ ৫ বছর মেয়াদি উন্নয়ন পরিকল্পনা তৈরি করে এবং স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে পরিকল্পনা কমিশনে অনুমােদনের জন্য পাঠায়।
আয়ের উৎস
জেলা পরিষদ আইন ১৯৯৮ অনুযায়ী জেলা পরিষদের ৮টি আয়ের উৎস আছে । কর, টোল, ফিস, সম্পত্তি হতে প্রাপ্ত আয়/ মুনাফা, ব্যক্তি, সরকার ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রদত্ত অনুদান, বিনিয়ােগ হতে প্রাপ্ত আয় এবং অন্যান্য উৎস হতে প্রাপ্ত অর্থ ।
জেলা পরিষদের জন্য জমি হস্তান্তর করের ১ শতাংশ এবং ৫ শতাংশ ভূমি কর রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এছাড়া হাট-বাজার, ফেরিঘাট এবং জলমহাল থেকে বর্ধিত পরিমাণ লিজের অর্থ জেলা পরিষদ পাবে । তবে গঠনতন্ত্রে যেভাবে বলা আছে, জেলা পরিষদ সম্পূর্ণ সেভাবে এখনও কার্যকর নয়।
পৌরসভা
গ্রামে যেমন ইউনিয়ন পরিষদ, তেমনি শহরের জন্য রয়েছে পৌরসভা। বর্তমানে বাংলাদেশে ৩২৫ টি পৌরসভা রয়েছে।
গঠন
স্থানীয় সরকার (পৌরসভা) আইন ২০০৯ অনুযায়ী পৌরসভা গঠিত হবে একজন মেয়র, সরকারি গেজেট প্রজ্ঞাপন দ্বারা নির্ধারিত সংখ্যক ওয়ার্ডের সমানসংখ্যক কাউন্সিলর এবং কেবল মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত নির্ধারিত সংখ্যক কাউন্সিলরের সমন্বয়ে ।
এই সকল পদেই জনগণের দ্বারা প্রত্যক্ষ ভােটে নির্বাচিত হওয়ার বিধান রাখা হয়েছে। কার্যাবলি পৌরসভা শহরের জনগণের স্থানীয় বহুবিধ সমস্যার সমাধান এবং উন্নয়নমূলক কাজের দায়িত্ব পালন করে।
এই দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে পৌরসভাকে বহুবিধ কাজ করতে হয়। উল্লেখযােগ্য কাজগুলাে নিমে আলােচনা করা হলাে।
১. পৌর এলাকায় শিক্ষা বিস্তারের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উন্নয়নের জন্য অনুদান প্রদান, হােস্টেল নির্মাণ, মেধাবী ও দরিদ্র শিক্ষার্থীদের বৃত্তি প্রদান, বয়স্ক শিক্ষা কেন্দ্র ও নৈশ বিদ্যালয় স্থাপন, পাঠাগার স্থাপন করা ইত্যাদি কাজ করে।
২. পৌরসভা শহরের জনস্বাস্থ্য রক্ষামূলক কার্যাদি সম্পন্ন করে। জনস্বাস্থ্য রক্ষার জন্য রাস্তাঘাট, পুকুর, নর্দমা ও ডাস্টবিন নির্মাণ করে। সংক্রামক ও মহামারী ব্যাধি প্রতিরােধ ও প্রতিষেধক দানের ব্যবস্থা করে। হাসপাতাল, মাতৃসদন, শিশুসদন, পরিবার পরিকল্পনা কেন্দ্র নির্মাণ ও পরিচালনার ব্যবস্থা করে ।
৩. মৃতদেহ দাফনের জন্য গােরস্তান, সকারের জন্য শ্মশান ইত্যাদি নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ করে।
অনাথ ও দুস্থদের জন্য এতিমখানা ও আশ্রম নির্মাণ করে ।
৪. জনগণের জন্য নিরাপদ খাওয়ার পানির এবং আবদ্ধ পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করে ।
৫. পৌর এলাকার জনগণের জীবন ও সম্পত্তি রক্ষার জন্য নৈশপ্রহরী নিয়ােগ করে। অপরাধমূলক ও বিপজ্জনক খেলা ও পেশা নিয়ন্ত্রণ করে ।
৬. পৌরসভা এলাকার পরিবেশ উন্নয়ন ও সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য রাস্তার ধারে বৃক্ষরােপণ ও বন সংরক্ষণ করে। জনগণের বিনােদনের জন্য পার্ক ও উদ্যান নির্মাণ, মিলনায়তন স্থাপন এবং উন্মুক্ত প্রাঙ্গণ সংরক্ষণ করে। ‘
৭. পৌর এলাকায় গবাদি পশু ও হাঁস-মুরগি পালন, খামার স্থাপন, গবাদি পশু ও হাঁস-মুরগির চিকিৎসার ব্যবস্থা করা, গবাদি পশু বিক্রি ও রেজিস্ট্রিকরণ, বিপজ্জনক পশু আটক ও হত্যা, পশুর মৃতদেহ অপসারণ ইত্যাদি কাজ করে।
৮.. খাদ্যে ভেজাল প্রতিরােধে, পচা ও ভেজাল খাবার বিক্রি বন্ধে প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে। মাদকজাতীয় খাদ্য ও পানীয় অবাধে বিক্রি বন্ধের জন্য এসব দ্রব্য প্রস্তুত, ক্রয়-বিক্রয় এবং সরবরাহের উপর বিধিনিষেধ আরােপ করে। বিধিনিষেধ লঙ্ঘনকারীকে শাস্তি দেয়।
৯. পরিকল্পিত শহর গড়ার জন্য পৌরসভা বাড়িঘর নির্মাণের অনুমতি দেয়। অননুমােদিত ও বেআইনি নির্মাণ ভেঙে দেয় ।
১০. সুপরিকল্পিত সুন্দর শহর গড়া এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য পৌরসভা মহাপরিকল্পনা গ্রহণ ও ,বাস্তবায়ন করে।
১১. পৌরসভা যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ করে এবং মােটরগাড়ি ছাড়া অন্যান্য যানবাহনের লাইসেন্স প্রদান করে।
১২. প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় পৌরসভা দুর্গতদের সাহায্য, সেবা এবং ত্রাণের ব্যবস্থা করে ।
১৩. পৌরসভা শান্তিপূর্ণ পরিবেশ রক্ষার জন্য সন্ত্রাস দমন ও শান্তি-শৃঙ্খলা ভঙ্গকারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করে।
১৪. পৌরসভা সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার টাকা মূল্য জড়িত দেওয়ানি ও ছােটখাটো ফৌজদারি মামলার
বিচার করতে পারে। এজন্য মেয়র ও চারজন কাউন্সিলরের সমন্বয়ে আদালত গঠন করা হয়।
বাংলাদেশের স্থানীয় সরকারব্যবস্থা
আয়ের উৎস
বিভিন্ন উৎস থেকে প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে পৌরসভা তার ব্যয়ভার নির্বাহ করে থাকে। এর মধ্যে উল্লেখযােগ্য হচ্ছেঘরবাড়ি, দোকানপাট, বিদ্যুৎ, পানি ও অন্যান্য সেবা এবং বিনােদনমূলক বিষয়ের উপর ধার্য কর, মার্কেট ভাড়া, হাট-বাজার ও খেয়াঘাট ইজারা, লাইসেন্স-পারমিট, যানবাহন রেজিস্ট্রেশন ফি, সরকারি বরাদ্দ ইত্যাদি।
সিটি কর্পোরেশন
বাংলাদেশের কয়েকটি প্রধান শহরকে কেন্দ্র করে সিটি কর্পোরেশনগুলাে গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশের মােট ১১টি সিটি কর্পোরেশন রয়েছে। এগুলাে হলাে ঢাকায় দুইটি (ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ), চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, সিলেট, বরিশাল, রংপুর, নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা ও গাজীপুর ।
গঠন
প্রত্যেক সিটি কর্পোরেশন নির্ধারিত সংখ্যক ওয়ার্ডে বিভক্ত থাকে। একজন মেয়র, নির্ধারিত ওয়ার্ডের সমানসংখ্যক কাউন্সিলর এবং নির্ধারিত ওয়ার্ডের এক-তৃতীয়াংশ সংখ্যক সংরক্ষিত আসনের মহিলা কাউন্সিলর নিয়ে সিটি কর্পোরেশন গঠিত হয়।
মেয়র ও কাউন্সিলরগণ জনগণের সরাসরি ভােটে নির্বাচিত হন এবং সংরক্ষিত আসনের মহিলা কাউন্সিলরগণ নির্বাচিত হন কাউন্সিলরদের ভােটে । সিটি কর্পোরেশনের মেয়র প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদা ভােগ করেন। সিটি কর্পোরেশনের মেয়াদ ৫ (পাঁচ) বছর।
কার্যাবলি
মহানগর এলাকার শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা, বিভিন্ন সমস্যার সমাধান এবং উন্নয়নের জন্য সিটি কর্পোরেশন বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পাদন করে থাকে। নিচে তা আলােচনা করা হলাে:
১. সিটি কর্পোরেশন মহানগরীর রাস্তাঘাট নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ করে। মােটরগাড়ি, বাস, ট্রাক ছাড়া অন্যান্য যানবাহনের লাইসেন্স প্রদান করে এবং রাস্তায় যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ করে।
২. জনস্বাস্থ্য রক্ষার জন্য সিটি কর্পোরেশন নালা-নর্দমা, রাস্তাঘাট, আবাসিক এলাকা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখে। ময়লা আবর্জনা ফেলার জন্য ডাস্টবিন নির্মাণ, বিভিন্ন স্থানে শৌচাগার, স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা ইত্যাদি নির্মাণ করে। এছাড়া হাসপাতাল, মাতৃসদন, শিশুসদন, পরিবার পরিকল্পনা কেন্দ্র নির্মাণ ও পরিচালনা করে।
৩. জনসাধারণের জন্য নিরাপদ খাওয়ার পানি সরবরাহ, কূপ ও নলকূপ খনন এবং আবদ্ধ পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করে। সিটি কর্পোরেশন মহানগর এলাকায় পচা-বাসি ও ভেজাল খাদ্যদ্রব্য বিক্রি ও সরবরাহের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করে ।
খাদ্য ও পানীয় সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করে। খাদ্য ও পানীয় প্রস্তুত, আমদানি ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে লাইসেন্স প্রদান করে।
৫. মহানগর এলাকায় গবাদি পশু ও হাঁস-মুরগি চিকিৎসা কেন্দ্র স্থাপন, গবাদি পশু রেজিস্ট্রিকরণ, বিপজ্জনক পশু আটক ও হত্যা, পশুর মৃতদেহ অপসারণ, হাঁস-মুরগির খামার স্থাপন ইত্যাদি কাজ করে।
৬. মহানগরীর গরিব-দুঃখী মানুষকে সাহায্য করা, অনাথ আশ্রম ও জনকল্যাণ কেন্দ্র স্থাপন, ভিক্ষাবৃত্তি ও পতিতাবৃত্তি রােধ ও পুনর্বাসন, জুয়াখেলা, মাদকাসক্তি ও অসামাজিক কাজ প্রতিরােধের ব্যবস্থা করে।
৭. প্রাকৃতিক দুর্যোগ মােকাবেলায় সিটি কর্পোরেশন ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্য ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করে ।
৮. মহানগরীর নিরক্ষরতা দূরীকরণের জন্য বয়স্ক শিক্ষা কেন্দ্র, নৈশ বিদ্যালয় স্থাপন করে। শিক্ষা
বিস্তারের জন্য নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনুদান প্রদান, হােস্টেল নির্মাণ, বৃত্তি
প্রদান, পাঠাগার নির্মাণ ও পরিচালনা ইত্যাদি কাজ করে।
৯. সাংস্কৃতিক উন্নয়নের জন্য সিটি কর্পোরেশন মিলনায়তন, আর্ট-গ্যালারি, তথ্যকেন্দ্র, জাদুঘর, মুক্তমঞ্চ ইত্যাদি নির্মাণ করে।
১০. মহানগরের পরিবেশের উন্নয়ন ও সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য সিটি কর্পোরেশন রাস্তার পাশে ও উন্মুক্ত স্থানে বৃক্ষরােপণ ও বন সংরক্ষণ করে। জনসাধারণের অবকাশ যাপনের জন্য উদ্যান নির্মাণ করে ।
১১. সিটি কর্পোরেশন মহানগর এলাকায় ঘরবাড়ি নির্মাণের অনুমতি প্রদান করে। অননুমােদিত ঘরবাড়িসহ সকল স্থাপনা ভেঙে দেয় এবং অবৈধ দখলদার উচ্ছেদের ব্যবস্থা করে ।
১২. সিটি কর্পোরেশন জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন করে ।
১৩. মহানগরীর শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য সিটি কর্পোরেশন ছােটখাটো বিচারকাজ সম্পাদন করে। বিবাদ মীমাংসা ও মহল্লায় শান্তি রক্ষার জন্য শান্তিরক্ষী নিয়ােগ করে। মহানগরীতে চুরি-ডাকাতি, হাইজ্যাকরােধ ও সন্ত্রাস দমনে প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে।
১৪. সর্বোপরি মহানগরীর সার্বিক উন্নয়নের জন্য সিটি কর্পোরেশন উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে।
আয়ের উৎস
ক. সিটি কর্পোরেশন কর্তৃক আরােপিত যেকোনাে কর, উপকর, টোল ও ফিস ইত্যাদি;
খ. কর্পোরেশনের উপর ন্যস্ত এবং তৎকর্তৃক পরিচালিত সকল সম্পত্তি হতে প্রাপ্ত আয় বা মুনাফা;
গ. সরকার বা অন্যান্য কর্তৃপক্ষের নিকট হতে প্রাপ্ত অনুদান;
ঘ. স্থানীয় কর্তৃপক্ষ বা অন্য কোনাে প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিবিশেষ কর্তৃক প্রদত্ত দান;
ঙ. কর্পোরেশনের উপর ন্যস্ত সব ট্রাস্ট হতে প্রাপ্ত আয়;
চ. কর্পোরেশনের অর্থ বিনিয়ােগ হতে প্রাপ্ত মুনাফা;
ছ, অন্যান্য উৎস হতে প্রাপ্ত অর্থ
জ, আইনের অধীন অর্থদণ্ড থেকে প্রাপ্ত অর্থ ইত্যাদি।
এই ধরনের আরও পোষ্ট পেতে আমাদের poramorso24.com নিয়মিত ভিজিট করুন । ধর্যসহকারে পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
আরও পড়ুন