বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পটভূমি: আজ আমরা স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক। ১৯৭১ সালে স্বাধীন হওয়ার আগে আমরা ছিলাম পাকিস্তানের নাগরিক। জনসংখ্যার দিক থেকে সংখ্যাগরিষ্ঠ (৫৬ শতাংশ) হওয়া সত্ত্বেও সে সময়ে পূর্ববাংলার (বর্তমান বাংলাদেশ) মানুষ নাগরিক হিসেবে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক অধিকার ভােগের ক্ষেত্রে সমান সুযােগ থেকে বঞ্চিত হয়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পটভূমি
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার কারণে এখন বাঙালিরা স্বাধীনভাবে তাদের নাগরিক অধিকার ভােগ করতে পারছে। পাকিস্তানি শাসনের (১৯৪৭-১৯৭১) আগে বাংলাদেশের এই অঞ্চল তুর্কি, আফগান, মুঘল এবং পরিশেষে ব্রিটিশ শাসনের (১৭৫৭-১৯৪৭) অধীন ছিল।
ব্রিটিশ শাসন আমলে ইংরেজি শিক্ষা প্রবর্তনের ফলে এদেশে পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত একশ্রেণির নেতৃত্ব গড়ে ওঠে। এই নেতৃত্ব রাজনীতি, সংগঠন, সমাজ-সংস্কার, চাকরি, ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি, শিক্ষা ইত্যাদি ক্ষেত্রে বিকাশলাভ করে।
ব্রিটিশ শাসনের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে ১৮৬১ সাল থেকে শুরু করে গৃহীত বিভিন্ন শাসনতান্ত্রিক সংস্কার। এর পথ ধরে পর্যায়ক্রমে জনগণ ভােটের অধিকার লাভ করে। এসবই ছিল ঐ সময়ে নাগরিক অধিকার ও সচেতনতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে উল্লেখযােগ্য অগ্রগতি।
১৯৪০ সালের লাহাের প্রস্তাব
ব্রিটিশ শাসন আমলে অবিভক্ত ভারতে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের পাশাপাশি মুসলিম জনগােষ্ঠীর মধ্যেও স্বশাসনের চেতনা জাগ্রত হয়। আর এ ক্ষেত্রে মুসলিম স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করে ১৯০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় মুসলিম লীগ। মুসলিম লীগ নেতা মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতের মুসলমানদেরকে একটি স্বতন্ত্র জাতি হিসাবে ঘােষণা করেন।
যার ফলে পরবর্তীকালে মুসলমান জনসাধারণের মধ্যে আলাদা আবাসভূমির চিন্তা জাগ্রত হয় ।
এই চিন্তাধারার আলােকেই ১৯৪০ সালের ২৩শে মার্চ পাঞ্জাবের লাহােরে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের বার্ষিক ও কাউন্সিল অধিবেশনে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী এ. কে. ফজলুল হক উপমহাদেশের মুসলমানদের স্বার্থ-সম্বলিত একটি প্রস্তাব পেশ করেন।
জিন্নাহর সভাপতিত্বে সভায় প্রস্তাবটি গৃহীত হয়। এই প্রস্তাবই ঐতিহাসিক লাহাের প্রস্তাব’ বা ‘পাকিস্তান প্রস্তাব’ নামে পরিচিত।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পটভূমি
লাহাের প্রস্তাবের মূল বক্তব্য বা বৈশিষ্ট্য ছিল নিম্নরূপ
- ১. ভৌগােলিক দিক থেকে সংলগ্ন এলাকাগুলােকে পৃথক অঞ্চল বলে গণ্য করতে হবে ।
- ২. এসব অঞ্চলের ভৌগােলিক সীমানা প্রয়ােজনমত পরিবর্তন করে ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলের যে সকল স্থানে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, সেখানে স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহ’ প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
- ৩. এ সমস্ত স্বাধীন রাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্য হবে সার্বভৌম ও স্বায়ত্তশাসিত।
- ৪. ভারতের ও নবগঠিত মুসলিম রাষ্ট্রের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সাংস্কৃতিক, শাসনতান্ত্রিক ও অন্যান্য অধিকার ও স্বার্থ সংরক্ষণের কার্যকর ব্যবস্থা করা হবে।
- ৫. দেশের যেকোনাে ভবিষ্যৎ শাসনতান্ত্রিক পরিকল্পনায় উক্ত বিষয়গুলােকে মৌলিক নীতি হিসেবে গ্রহণ করতে হবে ।
লাহাের প্রস্তাবের কোথাও পাকিস্তান’ কথাটি ছিল না, যদিও এ প্রস্তাব ‘পাকিস্তান প্রস্তাব’ নামে পরিচিতি লাভ করে। লাহাের প্রস্তাবে কার্যত ভারতের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দু’টি অঞ্চলে দুটি পৃথক রাষ্ট্র গঠনের চিন্তা করা হয়। ভৌগােলিক অবস্থান বিবেচনায়ও তা-ই হওয়ার কথা।
১৯৪৬ সালে জিন্নাহর নেতৃত্বে দিল্লি মুসলীম লেজিসলেটরস কনভেনশন’-এ মুসলমানদের একাধিক রাষ্ট্রপরিকল্পনাকে বাদ দিয়ে এক পাকিস্তান পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। সে অনুযায়ী ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট ভারত বিভক্ত হয়ে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হয়।
ভারত উপমহাদেশের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ উত্তরপশ্চিমাঞ্চল ও পূর্বাঞ্চল নিয়ে সৃষ্টি হয় পাকিস্তান ও বাকি অংশ নিয়ে ভারত ইউনিয়ন। ১৯৪০ সালের লাহাের প্রস্তাব’ ও জিন্নাহর ‘দ্বিজাতি তত্ত্ব’ পাকিস্তান সৃষ্টির মূলভিত্তি ছিল। এর উপর ভিত্তি করে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্রের উদ্ভব হলেও এর কাঠামােগত চরিত্রে মিল ছিল না। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান নিয়ে গঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রের দুই অংশ এক হাজারের অধিক মাইল ভারতীয় ভূখণ্ড দ্বারা বিভক্ত ছিল।
রাষ্ট্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালিদের ভাষা-সংস্কৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্য, পােশাক-পরিচ্ছদ, খাদ্যাভ্যাস ছিল পশ্চিম পাকিস্তানিদের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা। পশ্চিম পাকিস্তানি বিশেষ করে পাঞ্জাবিরা মনে করত, তাদের পূর্ব পুরুষেরা ভারতবর্ষের বাইরে থেকে আগত এবং তাদের ধমনিতে রয়েছে অভিজাতের রক্ত। এই ধরনের মানসিকতার কারণে পশ্চিম পাকিস্তানিরা বাঙালি মুসলমানদের নিচু জাতের মানুষ হিসেবে দেখত ।
বস্তুত পাকিস্তান রাষ্ট্রের শুরু থেকেই পূর্ব বাংলায় পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠী এক ধরনের অভ্যন্তরীণ বৈষম্যমূলক শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিল। এই শাসনকালে বাঙালিদের অবস্থা ছিল অনেকটা নিজ দেশে পরবাসীর মতাে ।
পূর্ব বাংলার বাঙালিদের উপর পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠীর বৈষম্যমূলক আচরণের প্রথম বহিঃপ্রকাশ ঘটে রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে। সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালিদের ভাষা বাংলার পরিবর্তে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তাদের ভাষা উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাঙালিদের উপর চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল।
ভাষা আন্দোলন
(১৯৪৮-১৯৫২) মাতৃভাষার অধিকার গুরুত্বপূর্ণ নাগরিক অধিকার। পাকিস্তানের শতকরা ৫৬ জনের মাতৃভাষা ছিল বাংলা; উর্দু কোনাে অঞ্চলেরই মাতৃভাষা ছিল না। অথচ উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা চালানাে হয়।
অগণতান্ত্রিকভাবে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে বাঙালিদের যে আন্দোলন শুরু হয়, তা-ই ভাষা অন্দোলন নামে পরিচিত। ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বর মাসে করাচিতে অনুষ্ঠিত শিক্ষা সম্মেলনে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব গ্রহণ করা হলে পূর্ব বাংলায় রাজনৈতিক নেতৃত্ব, বুদ্ধিজীবী ও ছাত্র নেতৃত্বের সমন্বয়ে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়।
তাদের দাবি ছিল বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা। যে কারণে আমরা দেখি, ১৯৪৮ সালের ২৩শে ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদে কুমিল্লার ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত উর্দু ও ইংরেজির পাশাপাশি বাংলাকে পরিষদের ব্যবহারিক ভাষা হিসেবে গ্রহণের দাবি প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে উত্থাপন করেন। কিন্তু রু থেকেই পাকিস্তানের শাসকগােষ্ঠী বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করতে সম্মত ছিল না।
ভাষা আন্দোলনের প্রথম পর্বে ১৯৪৮ সালের ১১এ মার্চ ছাত্ররা বাংলা ভাষা দাবি দিবস পালন করে। ঐ দিন সাধারণ ধর্মঘট পালনের কর্মসূচি ঘােষণা করা হয়েছিল। প্রধানত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত পূর্ব পাকিস্তান মুসলীম ছাত্রলীগের (প্রতিষ্ঠা ৪ঠা জানুয়ারি ১৯৪৮) নেতৃবৃন্দ এ আন্দোলনের অগ্রভাগে ছিল । ১১ই মার্চ সকালে সেক্রেটারিয়েটের সম্মুখে পিকেটিংরত অবস্থায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, শামসুল হক, অলি আহাদসহ অনেকে গ্রেপ্তার হন।
ভাষা আন্দোলনের এ পর্বে ১৯৪৮ সালের ২১শে মার্চ ঢাকায় প্রথম সফরে এসে রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সােহরাওয়ার্দী উদ্যান) পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা জিন্নাহ ঘােষণা করেন, “উর্দু এবং একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। ঐ ঘােষণার তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ হয়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পটভূমি
প্রতিবাদকারীদের মধ্যে বঙ্গবন্ধু ছিলেন অন্যতম। আন্দোলনের সূচনা ও তা সংগঠিত করতে তিনি কার্যত নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করেন। যে কারণে তাঁকে একাধিকবার গ্রেপ্তার বরণ করতে হয়। জিন্নাহর ঢাকা সফরে আসার পূর্বে পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীনের সঙ্গে ছাত্র নেতৃবৃন্দের একটি ৮-দফা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
এই চুক্তিতে বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মর্যাদা দেওয়ার বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়। ২৪শে মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে জিন্নাহ ভাষাসংক্রান্ত তার পূর্ব ঘােষণার পুনরাবৃত্তি করেন।
সেখানেও প্রতিবাদ উচ্চারিত হয়। বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার ব্যাপারে ছাত্রসমাজের সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তি সম্পূর্ণ ভঙ্গ করে ১৯৫২ সালের ২৬শে জানুয়ারি ঢাকার পল্টন ময়দানে খাজা নাজিমুদ্দীন উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার নতুন ঘােষণা দেন।
তার এ ঘােষণাকে কেন্দ্র করে শুরু হয় ভাষা আন্দোলনের দ্বিতীয় বা চূড়ান্ত পর্ব। কাজী গােলাম মাহবুবকে আহ্বায়ক করে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। এর পূর্বে আব্দুল মতিনকে আহবায়ক করে গঠিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি ।
খাজা নাজিমুদ্দীন কর্তৃক উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার নতুন ঘােষণা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পূর্ব বাংলার ছাত্রসমাজ বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মহিউদ্দিন আহমদ রাষ্ট্রভাষা বাংলা এবং রাজবন্দীদের মুক্তির দাবিতে বন্দী অবস্থায় ১৬ই ফেব্রুয়ারি থেকে আমরণ অনশন শুরু করেন, যা আন্দোলনে নতুন মাত্রা যুক্ত করে।
২১শে ফেব্রুয়ারি ছাত্রসমাজের পক্ষ থেকে সমগ্র পূর্ব বাংলায় সাধারণ ধর্মঘট ও বিক্ষোভ সমাবেশ পালনের কর্মসূচি ঘােষণা করা হয়।
সরকার কর্তৃক ২১শে ফ্রেব্রুয়ারির আগের দিন ঢাকা শহরে ১৪৪ ধারা জারি করে সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করা হয়। পূর্ব ঘােষিত কর্মসূচি অনুযায়ী ছাত্ররা একুশে ফেব্রুয়ারির দিন ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে সমাবেশ অনুষ্ঠান ও মিছিল বের করে। মিছিলে পুলিশ গুলি চালায়। গুলিতে শহীদ হন সালাম, বরকত, জব্বারসহ আরও অনেকে।
পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠী বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মেনে নিতে বাধ্য হয়। ১৯৫৬ সালের সংবিধানে তা স্বীকৃত হয়। বাঙালিরাই পৃথিবীতে একমাত্র জাতি, যারা ভাষার দাবিতে জীবন দিয়েছে।
ইউনেস্কোর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জাতিসংঘ (১৭ই নভেম্বর, ১৯৯৯) ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। বর্তমানে আমাদের শহীদ দিবস আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে বিশ্বের সর্বত্র উদযাপিত হচ্ছে।
ধর্মভিত্তিক জাতীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে পাকিস্তান সৃষ্টির পর ভাষা আন্দোলনে আত্মদানের মধ্য দিয়ে ধর্মীয় পরিচয়ের বাইরে ভাষার ভিত্তিতে বাঙালিরা এক জাতিসত্তার পরিচয়ে পরিচিত হয়। অতএব, ভাষা আন্দোলন বাংলার মানুষের নিজেদের অধিকারের চেতনার জায়গাটি তৈরি করে। এতে জাতীয় মুক্তির আকাঙ্ক্ষা আরও বেগবান হয়।
১৯৫৪ সালের নির্বাচন
১৯৫৪ সালের মার্চ মাসে পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। প্রাদেশিক পরিষদের মােট আসন সংখ্যা ছিল ৩০৯। ১৯৫৩ সালের নভেম্বর মাসে আওয়ামী লীগসহ সমমনা কতিপয় দল নিয়ে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ সরকারের বিরুদ্ধে যুক্তফ্রন্ট’ নামে একটি নির্বাচনি জোট গঠিত হয়।
ভাষা আন্দোলনের পর ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয় পূর্ব বাংলার নাগরিকদের রাজনৈতিক চেতনাকে আরাে বৃদ্ধি করে। নির্বাচনের প্রাক্কালে যুক্তফ্রন্ট সর্বস্তরের ভােটারদের আকৃষ্ট করতে ২১ দফাবিশিষ্ট একটি কর্মসূচি গ্রহণ করে, যেখানে বাঙালি নাগরিকদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারের দিকগুলাে তুলে ধরা হয়।
বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দান, ভাষাশহীদদের স্মরণে শহীদ মিনার নির্মাণ, ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে উদ্বৃত্ত জমি বিতরণ, পাট ব্যবসা জাতীয়করণ, লাহাের প্রস্তাব অনুযায়ী পূর্ব বাংলার জন্য পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন ২১ দফা কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত ছিল।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পটভূমি
এসব দাবি ছিল পূর্ব বাংলার জনগণের নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠার সাথে সরাসরি সম্পর্কিত। এই নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট ২৩৭টি মুসলিম আসনের মধ্যে ২২৩টি আসনে জয়লাভ করে। অন্যদিকে, পাকিস্তান আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী ও দল মুসলিম লীগ মাত্র ৯টি আসন পায়।
১৯৫৪ সালে নির্বাচনে জয়লাভের পর শেরে বাংলা একে ফজলুল হককে মুখ্যমন্ত্রী করে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা গঠন করা হয়। পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠী যুক্তফ্রন্টের হাতে মুসলিম লীগের শােচনীয় পরাজয় মনেপ্রাণে মেনে নিতে পারেনি। মাত্র ৫৬ দিনের মধ্যে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা বরখাস্ত করা হয় এবং পূর্ব বাংলায় গভর্নরের শাসন কায়েম করা হয়।
স্বাধীনতার দীর্ঘ ৯ বছর পর ১৯৫৬ সালে সর্বপ্রথম পাকিস্তানের জন্য একটি সংবিধান প্রণয়ন সম্ভব হয়। এতে বাঙালিদের কতিপয় দাবি বিশেষ করে বাংলাকে রাষ্ট্রের অন্যতম ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। তবে বেশি দিন ঐ সংবিধান কার্যকর হয়নি। ১৯৫৮ সালের ৭ই অক্টোবর জেনারেল ইস্কান্দর মীর্জা কর্তৃক তা বাতিল ঘােষিত হয়।
তিনি সারা দেশে সামরিক আইন জারি করেন। এর তিন সপ্তাহের মধ্যে ইস্কান্দর মীর্জাকে সরিয়ে জেনারেল আইয়ুব খান ক্ষমতা দখল করেন। তিনি সর্বজনীন ভােটাধিকার ভিত্তিক পশ্চিমা গণতন্ত্রের ধারণা প্রত্যাখ্যান করে মৌলিক গণতন্ত্রের ধারণা প্রবর্তন করেন।
১৯৫৯ সালের ২৬শে অক্টোবর জেনারেল আইয়ুব খান তার মৌলিক গণতন্ত্র আদেশ’ ঘােষণা করেন মৌলিক গণতন্ত্র ব্যবস্থাধীনে পাকিস্তানের উভয় অংশ থেকে ৪০,০০০ (চল্লিশ হাজার) করে মােট ৮০,০০০ (আশি হাজার) ইউনিয়ন কাউন্সিল সদস্য নিয়ে দেশের নির্বাচকমণ্ডলী গঠিত হয়।
এদের দ্বারা রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট, জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যবৃন্দ নির্বাচনের বিধান করা হয়। এই পদ্ধতিতে পরােক্ষ নির্বাচন পদ্ধতি সৃষ্টি করে নাগরিকদেরকে প্রত্যক্ষ ভােটের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয় । মৌলিক গণতন্ত্রের মাধ্যমে পরােক্ষ নির্বাচনপদ্ধতির কারণে পূর্ববাংলা জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতৃত্ব নির্বাচিত হওয়ার সুযােগ হারায়।
উপরন্তু, আইয়ুব সরকার কালাে আইন জারি করে জনপ্রিয় রাজনীতিকদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত রাখেন। আইয়ুব শাসন আমলেই বাঙালিদের মধ্যে বেশি করে আলাদা জাতিগত পরিচয়ের প্রকাশ ঘটে। ১৯৬২ সালে জেনারেল আইয়ুব খান নিজস্ব ধ্যান-ধারণানির্ভর একটি নতুন শাসনতন্ত্র দেন।
তাতে সংসদীয় সরকার এবং প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের ধারা বাদ দিয়ে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার প্রতিষ্ঠা করা হয় । রাষ্ট্রপতিকে এই ব্যবস্থার কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে অসীম ক্ষমতাধর এক ব্যক্তির শাসন প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানের ক্ষমতা দখল করার পর থেকে ১৯৬২ সালের জুন পর্যন্ত জেনারেল আইয়ুব খানের নেতৃত্বে সামরিক শাসন বহাল থাকে।
তিনি একটানা ৪৪ মাস সামরিক আইন দ্বারা দেশ পরিচালনা করেন। রাজনৈতিক দল ও এর তৎপরতা, সকল সভা-সমাবেশ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ঘােষণা করেন। পাকিস্তানের জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতা হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীসহ মােট ৭৮ জন রাজনীতিককে কালাে আইনের আওতায় একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত কোনােরূপ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত রাখেন।
১৯৬২ সালে শরীফ শিক্ষা কমিশন রিপাের্টে ৬ষ্ঠ শ্রেণি থেকে ডিগ্রি পর্যন্ত ইংরেজি পাঠ বাধ্যতামূলক, উর্দুকে জনগণের ভাষায় পরিণত করা এবং একই সাথে জাতীয় ভাষার জন্য একটি সাধারণ বর্ণমালা প্রবর্তনের চেষ্টা এবং সেক্ষেত্রে আরবির গ্রহণযােগ্যতা বিবেচনা, রােমান বর্ণমালার সাহায্যে পাকিস্তানি ভাষাসমূহকে লেখা, শিক্ষা খরচ শিক্ষার্থীদের বহন করা, ডিগ্রি কোর্সকে তিন বছর মেয়াদি করা ইত্যাদি ।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পটভূমি
সুপারিশ করা হয়। ছাত্ররা এই রিপাের্ট প্রত্যাখ্যান করে আন্দোলনে নামে। আইয়ুবের সামরিক শাসন চলাকালীন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ থাকে। তখন কোনাে কোনাে সংবাদপত্র বিশেষ করে দৈনিক ইত্তেফাক সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রশংসনীয় ও বলিষ্ঠ ভূমিকা পালনে অবতীর্ণ হয়। সঙ্গে সঙ্গে এসব পত্রিকার কণ্ঠরােধ করতে পদক্ষেপ গৃহীত হয়।
১৯৫৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পূর্ব বাংলার সবচেয়ে জনপ্রিয় দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার সম্পাদক ও মালিক তফাজ্জল হােসেন ওরফে মানিক মিয়াকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর ১৯৬২ ও ১৯৬৬ সালেও দুইবার তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। পাকিস্তানের শুরুতে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে দুই অংশের মধ্যে পূর্ব বাংলার অবস্থা ছিল অপেক্ষাকৃত ভালাে।
কিন্তু এই অবস্থা বেশি দিন টিকে থাকেনি। ক্রমান্বয়ে দুই অংশের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি এবং ব্যবধানের মাত্রা বৃদ্ধি পেতে থাকে। পাকিস্তানের দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে জেনারেল আইয়ুব বিভিন্ন নীতি গ্রহণ করেন। এই নীতি আঞ্চলিক বৈষম্যের পরিমাণ না কমিয়ে বরং তা আরাে বাড়িয়ে দেয়।
১৯৬৮ সালের এপ্রিল মাসে পাকিস্তান প্লনিং কমিশনের প্রধান অর্থনীতিবিদ মাহবুবুল হক তথ্য প্রকাশ করেন যে দেশের শতকরা ৬৬ ভাগ শিল্প, ৭৯ ভাগ বীমা এবং ৮০ ভাগ ব্যাংক সম্পদ মাত্র ২২টি পরিবারের হাতে (যার মধ্যে ১টি বাদে বাকি সব পশ্চিম পাকিস্তানি) কেন্দ্রীভূত।
জেনারেল আইয়ুব খানের এক দশকের শাসন আমলে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক সাহায্য পাওয়া যায়। এর সিংহভাগ পশ্চিম পাকিস্তানে খরচ হয়। পাকিস্তানের পূর্ব অংশের পুঁজি পশ্চিম অংশে পাচার হয়ে যায়।
৬ দফা কর্মসূচি
১৯৬৬ সালের ৫-৬ই ফেব্রুয়ারি পশ্চিম পাকিস্তানের লাহােরে বিরােধী দলের এক কনভেনশন অনুষ্ঠিত হয় । ঐ কনভেনশনে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার ঐতিহাসিক ৬ দফা কর্মসূচি উত্থাপন করেন। ৬ দফা কর্মসূচি ছিল সংক্ষেপে নিম্নরূপদফা-
- দফা-১ : লাহাের প্রস্তাবের ভিত্তিতে পাকিস্তান হবে একটি ফেডারেশন বা যুক্তরাষ্ট্র। সর্বজনীন ভােটাধিকারের ভিত্তিতে প্রত্যক্ষভাবে নির্বাচিত আইন পরিষদের প্রাধান্যসহ সংসদীয় পদ্ধতির সরকার গঠনের ব্যবস্থা থাকতে হবে।
- দফা-২: বৈদেশিক সম্পর্ক ও প্রতিরক্ষা ছাড়া সকল বিষয় স্টেট বা প্রদেশের হাতে ন্যস্ত থাকবে । উল্লিখিত দু’টি বিষয় ন্যস্ত থাকবে কেন্দ্রীয় বা যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের হাতে।
- দফা-৩ : পাকিস্তানের দুটি অঞ্চলের জন্য পৃথক অথচ অবাধে বিনিময়যােগ্য মুদ্রাব্যবস্থার প্রবর্তন করতে হবে । অথবা সমগ্র দেশে একটি মুদ্রাব্যবস্থা থাকবে, তবে সে ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে মূলধন পাচার রােধের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এজন্য একটি ফেডারেল ব্যাংকের অধীনে কার্যকরী ব্যবস্থা থাকতে হবে।
- দফা-৪ : অঙ্গরাষ্ট্র বা প্রদেশগুলাের কর বা শুল্ক ধার্য করার ক্ষমতা থাকবে। তবে ব্যয় নির্বাহের জন্য কেন্দ্রীয় সরকার এর একটি অংশ পাবে।
- দফা-৫ : পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পৃথক হিসাব রাখা হবে। অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা স্ব স্ব অঞ্চলের বা অঙ্গরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে থাকবে। এছাড়া কেন্দ্রীয় সরকারের বৈদেশিক নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বিদেশে বাণিজ্য প্রতিনিধি প্রেরণ এবং যেকোনাে চুক্তি সম্পাদন করতে পারবে।
- দফা-৬ : নিজস্ব নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য অঙ্গরাষ্ট্রসমূহ প্যারামিলিশিয়া বা আধাসামরিক বাহিনী গড়ে তুলতে পারবে ।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক উপস্থাপিত ৬ দফা কর্মসূচি ছিল বাঙালির জাতীয় মুক্তির সনদ বা ম্যাগনাকার্টা’। কার্যত এই ৬ দফার মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি ধাঁচের বৈষম্যমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থাকে ভেঙে বাঙালির জাতীয়-মুক্তি বা স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্য স্থির হয়। জেনারেল আইয়ুব খান ৬ দফাকে বিচ্ছিন্নতাবাদী, বৃহত্তর বাংলা প্রতিষ্ঠার কর্মসূচি হিসেবে আখ্যায়িত করেন এবং তা নস্যাৎ করতে যেকোনাে ধরনের শক্তি প্রয়ােগের হুমকি দেন।
৬ দফার সংগ্রামকে ব্যর্থ করে দেওয়ার লক্ষ্যে ১৯৬৮ সালের জানুয়ারি মাসে আইয়ুব সরকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে এক নম্বর আসামী করে ৩৫ জন বাঙালি সামরিক-বেসামরিক ব্যক্তির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক একটি মামলা দায়ের করে, যা ঐতিহাসিক আগরতলা মামলা নামে পরিচিত। এর আনুষ্ঠানিক নাম ছিল ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য।
এই মামলার আওতায় বঙ্গবন্ধু ও ৬ দফাপন্থী অন্যান্য আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দকে দীর্ঘ সময় বন্দী অবস্থায় কারা অভ্যন্তরে কাটাতে হয়। ফলে বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের নেতৃত্বভার সচেতন ছাত্রসমাজের উপর গিয়ে বর্তায়।
১৯৬৯ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম দিকে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন ও মতিয়া উভয় গ্রুপ), সরকারি ছাত্র সংগঠন জাতীয় ছাত্র ফেডারেশনের দোলন গ্রুপ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ঐক্যবদ্ধ হয়ে আইয়ুববিরােধী মঞ্চ, কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে।
ডাকসুর তকালীন সহ- সভাপতি অনলবর্ষী ছাত্রনেতা তােফায়েল আহমদ এর সভাপতি নির্বাচিত হন। বঙ্গবন্ধু ঘােষিত ৬ দফা কর্মসূচির প্রতি সর্বাত্মক সমর্থনসহ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ তাদের ১১ দফা কর্মসূচি ঘােষণা করে। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ জাতীয় রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহ অন্তর্ভুক্ত করে ১১ দফা ভিত্তিক একটি কর্মসূচি গ্রহণ করে।
এই কর্মসূচি পূর্ব বাংলার মানুষের জাতীয় মুক্তির বা স্বাধীনতার লক্ষ্যকে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করে। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ আগরতলা মামলা প্রত্যাহার এবং বঙ্গবন্ধুসহ সকল রাজবন্দীর মুক্তির দাবিতে দেশব্যাপী ছাত্র আন্দোলন শুরু করে।
বস্তুত ১৯৬৮ সালের নভেম্বর মাস থেকে ১৯৬৯ সালের মার্চ পর্যন্ত পাঁচ মাস সমগ্র পূর্ব বাংলায় গণবিদ্রোহ দেখা দেয়। একই সময় পশ্চিম পাকিস্তানেও আইয়ুব-বিরােধী ছাত্র আন্দোলন গড়ে উঠে।
৬ দফা ও ১১ দফার ভিত্তিতে পূর্ব বাংলার সকল শ্রেণির মানুষের মধ্যে একটি সুদৃঢ় নাগরিক ঐক্য গড়ে উঠার ভিত্তি তৈরি হয়। আগরতলা মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে ছাত্র আন্দোলন আরও তীব্র আকার ধারণ করে। সংঘটিত হয় ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান ।
গণ-অভ্যুত্থানের চূড়ান্ত পর্যায়ে ১৯৬৯ সালের ২৫শে মার্চ জেনারেল আইয়ুব খান ক্ষমতা থেকে বিদায় নিতে বাধ্য হন। আগরতলা মামলাবিরােধী গণ-অভ্যুত্থান স্বাধীন বাংলাদেশের উদ্ভবে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করে।
ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান
মৌলিক গণতন্ত্র, আগরতলা মামলা ও আইয়ুব শাহীর নির্যাতনের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের উভয় অংশে ১৯৬৯ সালে এক দুর্বার গণ-আন্দোলন শুরু হয়। ছাত্রসমাজের ১১ দফা কর্মসূচিতে শিক্ষার সুযােগ বৃদ্ধি, আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন, প্রাপ্তবয়স্কদের ভােটাধিকার, বাক-স্বাধীনতা, বৃহৎ শিল্প জাতীয়করণ, কৃষক-শ্রমিকের সুযােগ-সুবিধা বৃদ্ধি, নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি, জরুরি নিরাপত্তা আইন প্রত্যাহার, রাজবন্দীদের মুক্তি প্রভৃতি দাবি অন্তর্ভুক্ত ছিল।
পশ্চিম পাকিস্তানে এক ইউনিট বাতিল এবং পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সকল বিরােধী দল ঐক্যবদ্ধ হয়। এ সময় পশ্চিম পাকিস্তানে পুলিশের গুলিতে কয়েকজন ছাত্র নিহত হয়। এ হত্যার প্রতিবাদে সারা দেশে শুরু হয় গণ-আন্দোলন। বিরােধী দলগুলাে গণতান্ত্রিক সংগ্রাম পরিষদ (DAC) গঠন করে। শুরু হয় দেশব্যাপী তীব্র ছাত্র গণ-আন্দোলন।
আইয়ুব খানের পদত্যাগ, ১৯৬২ সালের সংবিধান বাতিল, এক ব্যক্তি এক ভােটের’ ভিত্তিতে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, আগরতলা মামলা প্রত্যাহার প্রভৃতি দাবিতে দেশব্যাপী গড়ে ওঠা আন্দোলন গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নেয়। আন্দোলনের ভয়ে ভীত হয়ে আইয়ুব খান আগরতলা মামলা প্রত্যাহার করেন।
বন্দী অবস্থা থেকে মুক্তিলাভের পর ২৩শে ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ সালে ঢাকায় রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সােহরাওয়ার্দী উদ্যান) এক বিশাল ছাত্র-জনতার সভায় বাঙালিদের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। ১৯৬৯ সালের ২৫শে মার্চ আইয়ুব খান সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে রাজনীতি থেকে বিদায় গ্রহণ করেন।
ক্ষমতাসীন হয়ে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খান উভুত রাজনৈতিক সংকট সমাধানে কতগুলাে গুরুত্বপূর্ণ ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। রাজনৈতিক দলের কার্যকলাপের উপর বিধিনিষেধ তুলে নেওয়ার ঘােষণা দেন। পাকিস্তানে প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে তিনি কতিপয় শাসনতান্ত্রিক পদক্ষেপ ঘােষণা করেন।
এর মধ্যে এক ব্যক্তি, এক ভােট প্রত্যেক প্রদেশের জন্য জাতীয় পরিষদে জনসংখ্যার ভিত্তিতে আসনসংখ্যা বণ্টননীতি ছিল অন্যতম। জাতীয় পরিষদের আসনসংখ্যা হবে ৩১৩, যার মধ্যে ১৩টি হবে সংরক্ষিত মহিলা আসন। প্রত্যেক প্রদেশের জন্য সর্বাধিক স্বায়ত্তশাসনের বিধান রাখা হয়। নির্বাচিত প্রতিনিধি কর্তৃক সংবিধান প্রণয়নের জন্য সর্বোচ্চ ১২০ দিন ধার্য করা হয় । প্রণীত সংবিধান রাষ্ট্রপতি কর্তৃক অনুমােদিত হওয়া আবশ্যকীয় করা হয়।
১৯৭০-এর নির্বাচন ও ফলাফল
১৯৭০ সালের নির্বাচনই ছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রথম সাধারণ নির্বাচন। প্রাপ্তবয়স্ক এবং জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলের ভােটাধিকারের ভিত্তিতে এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচন দু’দফায় যথাক্রমে ৭ই ডিসেম্বর ১৯৭০ এবং ১৭ই জানুয়ারি ১৯৭১ সালে অনুষ্ঠিত হয়।
নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী উল্লেখযােগ্য রাজনৈতিক দলগুলাে হচ্ছে- আওয়ামী লীগ, পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি), ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-ন্যাপ (ওয়ালী খান), মুসলিম লীগের বিভিন্ন গ্রুপ, জামায়াত-ই-ইসলামী, জমিয়তে উলামা-ই-ইসলাম, জমিয়তে উলামা-ই-পাকিস্তান, নিজাম-ই-ইসলাম, পাকিস্তান ডেমােক্রেটিক পার্টি (পিডিপি) ইত্যাদি।
এর মধ্যে প্রধান দুটি দল হচ্ছে, পূর্ব বাংলায় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ এবং পশ্চিম পাকিস্তানে জুলফিকার আলী ভুট্টোর নেতৃত্বাধীন পাকিস্তান পিপলস পার্টি। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইস্যু ছিল বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ ৬ দফা।
অপরদিকে, জুলফিকার আলী ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস পার্টির নির্বাচনি স্লোগান ছিল- “ইসলাম আমাদের বিশ্বাস, গণতন্ত্র আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থা এবং সমাজতন্ত্র আমাদের অর্থনীতি। পিপলস পার্টির প্রচারণার মূল বিষয়বস্তু ছিল-শক্তিশালী কেন্দ্র’, ‘ইসলামী সমাজতন্ত্র এবং অব্যাহত ভারত বিরােধিতা ।
অন্যদিকে মুসলিম লীগ ও অন্যান্য ইসলামপন্থী দল বা গ্রুপ তাদের নির্বাচনি প্রচারে পাকিস্তান পিপলস পার্টির মতাে ইসলামি সংবিধান, শক্তিশালী কেন্দ্র এবং ভারত বিরােধিতার উপর গুরুত্ব আরােপ করে।
অসহযােগ আন্দোলন
১লা মার্চ ১৯৭১ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান কর্তৃক পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘােষণা করা হয়। এর প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২রা মার্চ ঢাকায় এবং ৩রা মার্চ সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে হরতালের ডাক দেন। কার্যত ১লা মার্চ থেকেই পাকিস্তানি শাসনের বিরুদ্ধে অসহযােগ আন্দোলন শুরু হয়।
২রা মার্চ রাতে কাফু জারি করা হয়। ছাত্রজনতা কার্টু ভঙ্গ করে। সেনাবাহিনী গুলি চালায়। প্রতিদিন শতশত লােক হতাহত হয়। প্রতিবাদে-প্রতিরােধে জেগে উঠে বাংলাদেশ। উত্থান ঘটে বাঙালি জাতির। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ জাতির জনক । জয় বাংলা’ এ জাতির মুক্তির ধ্বনি । চারিদিকে বিদ্রোহ আর গগনবিদারী স্লোগান : বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’।
১৯৭১ সালের ২রা মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ছাত্র-জনতার সমাবেশে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন, ৩ মার্চ পল্টনের জনসভায় বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে ছাত্রসমাজের স্বাধীন বাংলাদেশের ইশতেহার পাঠ’, ‘স্বাধীন বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন’, ২৩শে মার্চ পাকিস্তান প্রজাতন্ত্র দিবসে পূর্ব বাংলার সর্বত্র পাকিস্তানি পতাকার পরিবর্তে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন বাঙালির জাতীয় উত্থানের স্বাক্ষর বহন করে।
১৯৭১ সালের ২রা মার্চ থেকে ২৫শে মার্চ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে সারা বাংলায় সর্বাত্মক অসহযােগ পালিত হয়। পূর্ব বাংলার সকল সরকারি-বেসরকারি অফিস, সেক্রেটারিয়েট, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, হাইকোর্ট, পুলিশ প্রশাসন, ব্যাংক-বীমা, ব্যবসা-বাণিজ্য, পরিবহন ইত্যাদি পাকিস্তান সরকারের নির্দেশ সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে পরিচালিত হয়।
১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বাঙালির জাতীয় জীবনে এক অবিস্মরণীয় দিন । এদিন ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সােহরাওয়ার্দী উদ্যান) লক্ষ জনতার স্বতঃস্ফূর্ত সমাবেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতির উদ্দেশ্যে এক গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেন। এই ভাষণে তিনি ঘােষণা দেন
ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তােল। তােমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মােকাবেলা করতে হবে। রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরাে দেব। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব, ইনশাআন্নাহ।… এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।
১৯৭১ সালের ১৫ই মার্চ ইয়াহিয়া খান ঢাকায় আসেন। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আলােচনায় বসার অনুরােধ জানান। ১৬ই মার্চ থেকে আলােচনা শুরু হয়। পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোসহ ও পশ্চিম পাকিস্তানের কয়েকজন নেতা আলােচনায় অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকচক্রের মূল
উদ্দেশ্য ছিল আলােচনায় নামে সময়ক্ষেপণ কলা এবং পাকিস্তান থেকে সৈন্য ও বস আমদানি করে বাঙালি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামকে টিভরে জন্ধ করে দেওয়া। ২৩শে মার্চ পাকিস্তান প্রতি দিবসে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে বাংলাদেশের ঘরে ঘরে পাকিস্তানের পতাকার স্কুলে স্বাধীন বাংলার আত্মীয় পতাকা উতােলন করা হয়।
২৪শে মার্চ আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ সংকট সমাধানের লক্ষ্যে শেষ চেষ্টা করেন। কিন্তু ২৫শে মার্চ ইয়ার্বিয়া খান কোনাে ৰকম ঘোষণা না দিয়েই সালে ঢাকা ত্যাগ করেন এবং ঐ ৰাতেই পাকিনি সেনাবাহিনীকে নিম বালিদের ওপর ঝাপিয়ে পড়ার নির্দেশ দেন। তারা চাকাসহ অন্যান্য শহরেও হাজাৰ হাজার নিরীহ, নিয়ন্ত্ৰ আঙ্কালিকে নির্মমভাবে হত্যা করে।
এই ব্রাতকে ইচ্ছািসে কালরাত্রি হিসেবে অভিহিত করা হয়। ২৫শে মার্চের এই কালাত্রিতেই অর্থাৎ ২৬শে মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘােষণা করেন এবং এয়ারলেসযােগে জা পাঠিয়ে দেন। বঙ্গবন্ধুর ঘোষবাণী শােনামাত্রই রামসহ দেশের বিল্লি জেলায় প্রষ্ঠিােধ গড়ে তােলা হয়।
দু হয় পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে বাঙালি আনসার ও সাধারণ মানুষের এক অসম লড়াই মা বাংলাদেশের ইতিহাসে মহান মুক্তিসুদ্ধ নামে পরিচিত। আনুমানিক রাত ১টা ৩০ মিনিটে (মধ্যঙ্গতে) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে গোপনে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যায়।
FAQ: বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পটভূমি
বাংলাদেশ কিভাবে স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে?
1971 সালের মার্চ মাসে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণার ফলে নয় মাসব্যাপী বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়, যার সমাপ্তি ঘটে পূর্ব পাকিস্তান গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
ভাষা আন্দোলনের ফলে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে?
ভাষা আন্দোলন পূর্ব বাংলা এবং পরে পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি জাতীয় পরিচয়ের দাবিকে অনুঘটক করে এবং 6-দফা আন্দোলন এবং পরবর্তীকালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং বাংলা ভাষা বাস্তবায়ন আইন, 1987 সহ বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের অগ্রদূত হয়ে ওঠে।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি কি হয়েছিল?
1952 সালের 21 ফেব্রুয়ারি পুলিশ সমাবেশে গুলি চালায় । আবদুস সালাম, আবুল বরকত, রফিক উদ্দিন আহমেদ, আব্দুল জব্বার ও শফিউর রহমান মারা যান এবং আরো শতাধিক আহত হন। এটি ছিল ইতিহাসে একটি বিরল ঘটনা, যেখানে মানুষ তাদের মাতৃভাষার জন্য তাদের জীবন উৎসর্গ করেছিল।
এই ধরনের আরও পোষ্ট পেতে আমাদের poramorso24.com নিয়মিত ভিজিট করুন । ধর্যসহকারে পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
আরও পড়ুন