ব্যক্তিগত আচরণ নিয়ন্ত্রনের উপায়: ব্যক্তিগত আচরণ কার্যকর সংযােগ স্থাপনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ক্যারিয়ারে সফলতা অর্জনে ব্যক্তিগত আচরণের গুরুত্ব অনস্বীকার্য । কিন্ত ব্যক্তিগত আচরণ বলতে আসলে কী বােঝায়? ব্যক্তিগত আচরণ হলােআমাদের আবেগ, অনুভূতি ও মনােভাবের বহিঃপ্রকাশ।
কর্মক্ষেত্রে সফলতা অর্জন করতে চাইলে আমাদের ব্যক্তিগত আচরণ অবশ্যই পরিশীলিত হতে হবে আমাদের ব্যক্তিগত আচরণ এমন হতে হবে যা অন্যের নিকট কেবল গ্রহণযােগ্যই নয়, বরং প্রশংসার দাবিদার। এসাে একটি ঘটনা যাচাই করিহাসান আলি একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় ফিল্ড সুপারভাইজার পদে চাকরি করেন।
তার দায়িত্ব হলাে মাঠকর্মীদের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ এবং তাদের কাজের সমন্বয় সাধন করা। একবার একজন মাঠকর্মীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযােগ উঠল । হাসান আলি সাহেব এই দুর্নীতির বিষয়ে অবগত হয়ে তার সত্যতা যাচাই করে দেখলেন। অভিযােগ প্রমাণিত হওয়ায় তিনি ঐ মাঠকর্মীকে ডাকলেন এবং কেন দুর্নীতি করেছেন- তা ব্যাখ্যা করতে বললেন।
অভিযুক্ত মাঠকর্মী ইনিয়ে-বিনিয়ে তার অভাব ও নানা সমস্যার কথা বলতে লাগলেন। হাসান আলি আবেগের বশবর্তী না হয়ে অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে শক্ত ব্যবস্থা নিলেন। ফলে আর কোনাে মাঠকর্মী বা অন্য কোনাে কর্মী কোনরকম দুর্নীতিতে জড়ালেন না। এতে একদিকে যেমন সৎ কর্মকর্তা হিসেবে হাসান আলি সাহেবের সুনাম ছড়িয়ে পড়ল, তেমনি সংস্থার ভাবমূর্তিও উজ্জ্বল হলাে।
তিনি যদি দুর্নীতিবাজ কর্মীর বিরুদ্ধে শক্ত ব্যবস্থা না নিতেন, তবে হয়তাে ঐ অভিযুক্ত মাঠকর্মী আরও বড় ধরনের দুর্নীতির সাথে জড়িয়ে পড়তেন। এতে একদিকে প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হতাে, অন্যদিকে স্থানীয় জনগণও ক্ষতির সম্মুখীন হতাে। এ তাে গেল, কর্মজীবনের কথা। কিন্তু কর্মজীবনে প্রবেশের আগেও আবেগ, অনুভূতি ও মনােভাবের পরিশীলিত অনুশীলন প্রয়ােজন।
আবেগ
প্রত্যেক মানুষের মধ্যে আবেগ আছে। মানুষ কখনাে খুব খুশি হয়, আনন্দে লাফিয়ে ওঠে; কখনাে ক্ষুব্ধ হয়, কখনাে বিষন্ন হয়। মানুষের এই আনন্দ-বেদনা প্রকাশের যে উপায় এগুলােই হচ্ছে আবেগ। আবেগ মানুষের বিশেষ মানসিক অবস্থা । মানুষের অনুভূতি মিশ্রিত মানসিক অবস্থাকে আবেগ বলে। আমাদের দেশকে যে আমরা গভীরভাবে ভালােবাসি, এটি এক ধরনের আবেগ।
আবার কোনাে কিছু আমরা পছন্দ করি বা অপছন্দ করি সেটাও এক ধরনের আবেগ । আমাদের স্বকীয়তা টিকিয়ে রাখতে আবেগ খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। আবেগ আমাদের বাস্তব জীবনে চারপাশের মানুষের সাথে সম্পর্ক ও মিথস্ক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। আবেগ সাধারণত ক্ষণস্থায়ী হয়ে থাকে। তবে কোনাে বিষয় যদি বাস্তব জীবনের সাথে সম্পর্কিত হয়, কিংবা কোনাে দর্শন-নির্ভর হয়, সেক্ষেত্রে ঐ বিষয় সংক্রান্ত আবেগ দীর্ঘস্থায়ী হয়ে থাকে।
আমাদের পারস্পরিক সম্পর্ক আবেগের সাথে সম্পর্কিত। আমাদের মা-বাবা, ভাই-বােন, বন্ধু কিংবা সহকর্মীদের সাথে সম্পর্ক কেমন তা অনেকটাই নির্ভর করে তাদের প্রতি আমাদের আবেগিক দৃষ্টিভঙ্গি কেমন তার উপর। কর্মক্ষেত্রে আবেগ খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়, বিশেষত যখন দলবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হয়। কর্মক্ষেত্রে পারস্পরিক সম্মানবােধ, সহমর্মিতা, বিশ্বাস, আস্থা ইত্যাদি আবেগিক দৃষ্টিভঙ্গির উপর নির্ভরশীল।
আবেগ নিয়ন্ত্রণ :
আবেগের ভালাে মন্দ দিক দুটোই আছে। ইতিবাচক আবেগ যেমন মানুষকে বিকশিত করতে সাহায্য করে, তেমনি নেতিবাচক আবেগ মানুষকে ধ্বংসের দিকে ধাবিত করে। তাই আবেগ নিয়ন্ত্রণের প্রয়ােজন রয়েছে।
আবেগ-আপ্লুত অবস্থায় মানুষ কোনাে যুক্তি মানতে চায় না। ভালাে-মন্দ বিচার-বিশ্লেষণ করে যৌক্তিকভাবে নিজের অনুভূতিকে নিয়ন্ত্রণ করাই আবেগ নিয়ন্ত্রণ। অর্থাৎ আবেগে ভেসে না গিয়ে যৌক্তিকভাবে আচরণ করাকে আবেগ নিয়ন্ত্রণ বলে।
আবেগ নিয়ন্ত্রণের উপায়: জীবনে উন্নতি করতে বা প্রতিষ্ঠিত হতে চাইলে অবশ্যই আমাদের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ভয়, রাগ, হিংসা, ঈর্ষা, হতাশা ইত্যাদি ক্ষতিকর আবেগ নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রয়ােজন আত্মবিশ্বাস ও ক্রমাগত অনুশীলন। কখনও বিষন্ন থাকা চলবে না।
মনে রাখতে হবে বাল্যকাল ও কৈশাের জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সময়। এসময় কোন ভারী দায়িত্ব থাকে না। সুতরাং লেখাপড়ায় ভালােভাবে মনােনিবেশ করতে হবে। সময় পেলে পাঠ্যবই ছাড়াও ভালাে ভালাে বই পড়তে হবে, বেড়াতে যেতে হবে, খেলাধুলা করতে হবে।
মা-বাবার কাছে বিপদ বা সমস্যার বিষয়ে সব খুলে বলতে হবে। ক্রোধ, ঈর্ষা, ভয়, হতাশা এগুলাে আবেগের বিভিন্ন রূপ বা প্রকাশ। এ ধরনের নেতিবাচক বা ক্ষতিকর আবেগ নিয়ন্ত্রণের উপায় হচ্ছে।
- ১. ক্রোধ, ভয় বা হতাশার সঠিক কারণ চিহ্নিত করা;
- ২. কারণটি/কারণগুলাে দূর করার ব্যবস্থা নেওয়া;
- ৩. নির্ভরযােগ্য আত্মীয়, নিকটজন, শিক্ষক, বন্ধু এদের সাথে বিষয়টি নিয়ে খােলাখুলি আলােচনা করা;
- ৪. নির্ভরযােগ্য এবং নিজেকে ভালােবাসেন এমন ব্যক্তির দেওয়া পরামর্শ মেনে চলা;
- ৫. ভয় বা হতাশা কাটিয়ে ওঠার জন্য দৃঢ় ইচ্ছা পােষণ করা;
- ৬. রাগী বা ক্রদ্ধ মানুষকে কেউ পছন্দ করে না, এ কথা সবসময় মনে রাখা।
নিয়ন্ত্রিত আবেগ জীবনকে সুন্দর করে, উপভােগ্য করে। অতিরিক্ত আবেগ দ্বারা চালিত হলে নানা রকম ক্ষতি হতে পারে । তাই আবেগ সামলে চলা ও নিয়ন্ত্রণে রাখা একান্ত
অনুভূতি
আবেগের চেয়ে অনুভূতি তুলনামূলক দীর্ঘস্থায়ী। কোনাে বিষয়, কোনাে ঘটনা আমাদের মনের গভীরে বা হৃদয়ের গহীনে যে ভাব তৈরি করে, তাই হলাে অনুভুতি | আবেগ আমাদের মনে অনুভূতির জন্ম দেয়।
যেমন আমাদের আপনজনদের প্রতি আমাদের স্থায়ী ভালােবাসার অনুভূতি রয়েছে। কোনাে কাজ যখন আমাদের ভালাে লাগে, তখন সেই কাজের প্রতি আমাদের ভালােলাগার অনুভূতি সৃষ্টি হয়, যা আমাদের ওই কাজে লেগে থাকতে বা ঐ কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করে।
কোনাে নতুন বিষয় যখন আমাদের সামনে আসে, কোনাে নতুন ঘটনা যখন আমাদের সামনে ঘটে তখন সেই বিষয় বা ঘটনার প্রতি তাৎক্ষণিক অনুভূতি আমাদের মধ্যে এক ধরনের আবেগের জন্ম দেয়।
কর্মক্ষেত্রে সহকর্মীদের সাথে সম্পর্ক তৈরিতে অনুভূতির গুরুত্ব অনেক। আমরা যখন কোনাে চাকরি পাওয়ার জন্য কোনাে ধরনের মৌখিক পরীক্ষা দেই, তখন যারা পরীক্ষক হিসেবে আমাদের সামনে উপস্থিত থাকেন, আমাদের আচার-আচরণ, আবেগ-অনুভূতি ইত্যাদি তাদের মনেও এক ধরনের অনুভূতির জন্ম দেয়। তারা যখন কোনাে প্রার্থীকে চাকরির জন্য নির্বাচন করেন, তখন তাদের সেই অনুভূতি সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে বেশ ভূমিকা পালন করে
মনােভাব
কোনাে বিষয়, ঘটনা বা মতবাদ সম্পর্কে আবেগ ও অনুভূতির ফলে আমাদের মনে যে ভাবের সৃষ্টি হয় তাই হলাে মনােভাব । কোনাে বিষয় সম্পর্কে আমাদের মনােভাব দুই রকম হতে পারে ইতিবাচক মনােভাব ও নেতিবাচক মনােভাব। ইতিবাচক মনােভাব যেমন সাফল্যকে ত্বরান্বিত করে তেমনি নেতিবাচক মনােভাব সাফল্যকে করে বাধাগ্রস্ত।
নেতিবাচকের চেয়ে ইতিবাচক কর্মকাণ্ড ও মনােভাব সবার কাছেই বেশি গ্রহণযােগ্য । কেউ যদি সত্যিই সফল হতে চান সেক্ষেত্রে তার প্রথম কাজ হবে ইতিবাচক মনােভাব তৈরি করা। একটি গল্প হয়তাে আমাদের অনেকের জানা। কোনাে জুতা কোম্পানির দুজন বিক্রেতাকে পৃথকভাবে পাঠানাে হয়েছিল এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে জুতার সম্ভাব্য বাজার নির্ধারণ করতে।
একজন এসে বলেন যে, ওখানে জুতার কোনাে বাজারই নেই। পাঁচ হাজার লােকের বসবাস সেখানে কিন্তু কেউ জুতা পায়ে দেয় না। অপরজন বলেন যে, ওখানে জুতার বাজারের বিপুল সম্ভাবনা কারণ পাঁচ হাজার লােকের কেউই জুতা পায়ে দেয় না। তােমরা কি বলতে পারাে, এই দুজনের মধ্যে কার মনােভাব ইতিবাচক আর কার নেতিবাচক?
একজন নিরাশাবাদী মানুষ অনেক সম্ভাবনার মধ্যেও সমস্যা খুঁজে বের করতে পারেন না। আর একজন আশাবাদী মানুষ অনেক সমস্যার মধ্যেও খুঁজে বের করতে পারেন সম্ভাবনা। যখন তুমি কোনাে কাজে নেতৃত্ব দেবে তখন ইতিবাচক মনােভাব না থাকলেও হয়তাে কাজটি সম্পন্ন হবে কিন্তু তােমার ইতিবাচক মনােভাব সবাইকে তার নিজের সবচেয়ে ভালাে কাজটুকু করতে উৎসাহিত করবে।
ইতিবাচক মনােভাব কর্মক্ষেত্রে সফলতা অর্জনের জন্য খুবই দরকার। তাই আমরা কী করে আরও বেশি ইতিবাচক মনােভাবের অধিকারী হতে পারি, এসাে সেই উপায়গুলাে জেনে নিই :
লক্ষ্যের সাথে সংগতি রেখে কাজ করা
কোনাে কাজ শুরু করার আগে ভাবাে এটি কীভাবে তােমাকে তােমার লক্ষ্যে পৌঁছে দেবে। যদি তােমার কাজ আর লক্ষ্যের মধ্যে মিল না থাকে তবে তা না করাই ভালাে। উদ্দেশ্যহীন কাজ শুধু তােমার সময় আর শক্তিই নষ্ট করবে।
লক্ষ্যে অবিচল থাকা
সাধারণত জীবনের নানা ক্ষেত্রে অনেক সিদ্ধান্ত নিতে হয় এবং মানুষ যেমন ফলাফল চায় সে অনুযায়ী তাকে পরিকল্পনা করতে হয়। কিন্তু আগে থেকে কোনাে সুনির্দিষ্ট ফল আশা করা একধরনের বােকামি।
কোনাে কারণে প্রত্যাশিত ফল অর্জন না হলে তা হতাশার জন্ম দেয়। নিজের সবটুকু দিয়ে চেষ্টা চালাতে হবে । যদি সফলতা একবারে না আসে, তবে বার বার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে ।
ইতিবাচক মনােভাবাপন্ন মানুষের সাথে বন্ধুত্ব তৈরি
মানুষ তার অজান্তেই চারপাশের মানুষ দ্বারা প্রভাবিত হয়। অন্যকে মানুষ অনুকরণও করে। এ কারণে ইতিবাচক মনােভাবাপন্ন মানুষের সাথে মিশলে তার প্রভাব পড়বে। আর নেতিবাচক মনোেভাবাপন্ন মানুষের সাথে মিশলে দৃষ্টিভঙ্গিও নেতিবাচক হবে। তাই সবসময় ইতিবাচক মনােভাবাপন্ন মানুষের সাথে মিশা উচিত।
অন্যদের অক্ষমতা সহজভাবে নেওয়া
সবার কাজ করার ক্ষমতা একই রকম হয় না। যেভাবে তুমি একটি কাজ করতে পারতে ঠিক সেভাবে অন্য কেউ নাও করতে পারে, তাই এটি নিয়ে মন খারাপ করা বা কারও সাথে তাকে নিয়ে হাসিঠাট্টা বা খারাপ মন্তব্য করা ঠিক নয়। এটা এক ধরনের হীনমন্যতা।
অন্যের কাজের প্রশংসা করা
কৃতজ্ঞতাবােধ তৈরি হবে তখনই যখন তুমি জীবনের ছােট ছােট দুঃখ-কষ্টগুলােকে সরিয়ে প্রাপ্তিগুলােকেই বড় করে দেখবে। অন্যদের দেওয়া উপহারগুলাের জন্য হাসিমুখে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে। অন্যকে তাদের কাজের প্রশংসা করতে ভুলবে না।
আরও পড়ুন