Breaking News

আমাদের সংস্কৃতি: আনিসুজ্জামান

আমাদের সংস্কৃতি- আনিসুজ্জামান: সংস্কৃতি বলতে আমরা সাধারণত সাহিত্য শিল্প নৃত্যগীতবাদ্য বুঝে থাকি। এগুলাে সংস্কৃতির অপরিহার্য অঙ্গ, তবে এগুলােই সংস্কৃতির সবটা নয়। সংস্কৃতি বলতে মুখ্যত দুটো ব্যাপার বােঝায় বস্তুগত সংস্কৃতি আর মানস-সংস্কৃতি। ঘরবাড়ি, যন্ত্রপাতি, আহারবিহার, জীবনযাপন প্রণালি- এসব বস্তুগত সংস্কৃতির অন্তর্গত। আর সাহিত্যে-দর্শনে শিল্পে-সঙ্গীতে মানসিক প্রবৃত্তির যে বহিঃপ্রকাশ ঘটে, তাকে বলা যায় মানস-সংস্কৃতি। বস্তুগত আর মানস-সংস্কৃতি মিলিয়েই কোনাে দেশের বা জাতির সাংস্কৃতিক পরিচয় ফুটে ওঠে। 

বাংলাদেশে আমরা যে সংস্কৃতির উত্তরাধিকার বহন করছি, তা অনেক পুরনাে। এই সংস্কৃতির কিছু বৈশিষ্ট্য প্রতিবেশী দেশগুলাের সঙ্গে মেলে, কিছু বৈশিষ্ট্য আলাদা করে শনাক্ত করা যায়। নৃতাত্ত্বিক বিচারে, কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির বিকাশে, ধর্মানুপ্রেরণায়, বর্ণপ্রথায়, উৎপাদন-পদ্ধতির অনেকখানিতে বাঙালি সংস্কৃতির মিল পাওয়া যাবে গােটা উপমহাদেশের সঙ্গে। 

বাংলাভাষা ইন্দোইউরােপীয় গােষ্ঠীর ভাষা- এই গােষ্ঠীর অন্যান্য ভাষা ছড়িয়ে আছে উপমহাদেশের উত্তরাঞ্চলে। বাংলার অনেক রীতিনীতিরও মিল খুঁজে পাওয়া যায় সেই এলাকায়। আবার ধান-তেল-হলদি-পানসুপারির ব্যবহারে মিল পাওয়া যায় দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে। সেলাইছাড়া কাপড় পরার বিষয়েও বেশি মিল ঐ এলাকার সঙ্গে। 

এর কারণ, বাংলার আদি জনপ্রবাহ ছিল প্রাক-আর্য নরগােষ্ঠীসম্ভুত। পরে এর ওপরে আর্য জনগােষ্ঠী ও তাদের প্রভাব এসে পড়ে। সে প্রভাব এত তীব্র ছিল যে, তাই দেশজ উপকরণে পরিণত হয়। পরে মুসলমানরা যখন এদেশ জয় করলেন, তখন তাঁরা যে সংস্কৃতি নিয়ে এলেন, তাতে তুর্কি-আরব-ইরান-মধ্য-এশিয়ার সাংস্কৃতিক উপাদানের মিশেল ছিল।

সেখান থেকে অনেক কিছু এল বাঙালি সংস্কৃতিতে। তারপর এদেশে যখন ইউরােপীয়রা এলেন, তখন তারা এদেশের সংস্কৃতির সঙ্গে যােগ ঘটালেন আরাে একটি সংস্কৃতির। এভাবে বাংলার সংস্কৃতিতে অনেক সংস্কৃতি- প্রবাহের দান এসে মিশেছে। আর নানা উৎসের দানে আমাদের সংস্কৃতি হয়েছে পুষ্ট। বাংলার প্রকৃতি ও ভৌগােলিক অবস্থান আমাদের সংস্কৃতিতে দান করেছে স্বাতন্ত্র। 

ভৌগােলিক বৈশিষ্ট্যের দরুন বাংলায় বিভিন্ন রাজত্ব যেমন স্থায়িত্ব লাভ করতে সমর্থ হয়েছে, তেমনি বাংলার এই। বিচ্ছিন্নতার ফলে ধর্মমতের ক্ষেত্রে বিদ্রোহ ও উদ্ভাবন দেখা দিয়েছে। 

ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের প্রভাব লক্ষ করা যায়। সর্পদেবী মনসার মাহাত্ম গান ভিত্তি করে লেখা মনসামঙ্গল কাব্যের উদ্ভব পূর্ববঙ্গের জলাভূমিতে, পশ্চিমবঙ্গের রুক্ষ মাটিতে বিকাশ বৈষ্ণব পদাবলীর। 

নদীমাতৃক পূর্ববঙ্গে ভাটিয়ালি গানের বিস্তার, শুষ্ক উত্তরবঙ্গে ভাওয়াইয়ার, আর বাংলা পশ্চিমাঞ্চলে কীর্তন ও বাউলের। শিল্পসামগ্রীর লভ্যতাও প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল। তাই বাংলার স্থাপত্যে পাথরের চেয়ে ইট আর মাটির প্রাধান্য, মৃত্যলক এখানকার অনন্য সৃষ্টি।

বাংলার ভাস্কর্যেও মাটির প্রাধান্য, আর সেই সঙ্গে দেখা যায় এক ধরনের সামগ্রীর ওপরে অন্য ধরনের সামগ্রীর উপযােগী শিল্প সৃষ্টির প্রয়াস। অন্যদিক দিয়ে বিচার করলে দেখা যাবে যে, বাংলার মানস-সংস্কৃতি প্রধানত আশ্রয় করেছে সাহিত্য ও সঙ্গীত, অধ্যাত্মচিন্তা ও দর্শনকে। স্বল্প হলেও স্থাপত্য, ভাস্কর্য ও চিত্রকলার ক্ষেত্রে বাংলার দান আছে। কিন্তু বিজ্ঞান ও গণিতের সাধনার তেমন ঐতিহ্য বাংলায় গড়ে ওঠেনি।

ফলিত বিজ্ঞানের একটি ক্ষেত্রে আয়ুর্বেদশাস্ত্রে বাংলার একটা ভূমিকা ছিল, কিন্তু তাও ছিল সীমাবদ্ধ। প্রযুক্তির ক্ষেত্রে বাংলার অগ্রগতি দেখা দিয়েছিল মূলত কারুশিল্পে। তবে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এই কারুশিল্প বিকশিত হলেও এর প্রযুক্তিতে বৈপ্লবিক কোনাে পরিবর্তন ঘটেনি। প্রযুক্তির ক্ষেত্রে বড় পরিবর্তন হয়েছে ইংরেজ আমলে। তবে সে প্রযুক্তি বাংলার নিজস্ব সৃষ্টি নয়, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্র থেকে ধার করা। 

বাংলার সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র পরিস্ফুট হতে থাকে খ্রিস্টীয় সপ্তম-অষ্টম শতাব্দী থেকে। এই স্বাতন্ত্র দেখা দেয় শাসন-ব্যবস্থায়, সামাজিক জীবনে ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে। বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও লিপির বিকাশ সে স্বাতন্ত্র্যকে অর্থপূর্ণ করে তােলে। বহিরাগত মুসলমানরা এদেশ জয় করেন ত্রয়ােদশ শতাব্দীর শুরুতে। মুসলমান শাসকেরা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপােষকতা করে তার বিকাশে সহায়তা করেন। ষােড়শ শতাব্দীর শেষে মুঘলরা বাংলাদেশ জয় করেন। 

মুঘল আমলে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য আগের মতাে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপােষকতা লাভ করেনি, তবে একটা বৃহত্তর পরিবেশের সঙ্গে তখন বাংলার সংস্কৃতির যােগ ঘটে। তারপর আঠারাে শতকের মধ্যভাগে ইংরেজ শাসন প্রবর্তিত হলে যােগাযােগের পরিধি আরাে বিস্তৃত হয়; বিশ্বসংস্কৃতির সঙ্গে বাংলার যােগ সাধিত হয়। 

ঐ সময় পর্যন্ত বাংলাদেশে উচ্চবর্গের সংস্কৃতির সঙ্গে নিম্নবর্গের সংস্কৃতির কিছু কিছু ভেদ ছিল। কারুশিল্পের ক্ষেত্রে ভেদটা খুব চোখে পড়ে। এর একটা ধারা ছিল উচ্চ শ্রেণির ভােগ্য- রুপাের কাজ, হাতির দাঁতের কাজ, রেশমী ও উঁচু মানের সুতি কাপড়ের শিল্প; অন্য ধারাটা ছিল সাধারণের ভােগ্য- শাঁখের ও পিতলের কাজ, নকশী কাঁথা, পাটি, আলপনা। 

সমাজে উঁচু পর্যায়ে সংস্কৃত বা ফারসির যে-চর্চা হতাে তা নিচু স্তরকে স্পর্শ করে নি। ধ্রুপদী সঙ্গীত ও লােকসঙ্গীত চর্চার মধ্যেও এমনি পার্থক্য ছিল। লােকসাহিত্য ও শিষ্ট সাহিত্যের ভেদও ছিল। তবে বাংলার সাহিত্য ও সঙ্গীত সমাজের প্রায় সকল স্তরকে স্পর্শ করতে সমর্থ হয়েছিল। এইজন্যে বাংলার মানস-সংস্কৃতিতে সবচেয়ে প্রাধান্য সাহিত্য ও সঙ্গীতের।

ইংরেজ আমলে যে নতুন সাংস্কৃতিক বিকাশ ঘটে, তার প্রেরণা এসেছিল প্রধানত পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সংস্কৃতি থেকে। পাশ্চাত্য শিল্প ও সংস্কৃতির সঙ্গে যাদের যােগ ঘটেনি, তারা এর বিকাশে এবং এর উপভােগ্যতায়ও অংশ নিতে পারে নি। 

একালের সাহিত্য-সঙ্গীত-নাটক-চিত্রকলা প্রধানত নগরের সৃষ্টি। এর অর্থ আমাদের মানস-সংস্কৃতির শ্রেষ্ঠ রুপ নির্মিত হয় উচ্চ ও মধ্য শ্রেণির মুষ্টিমেয় ইংরেজি শিক্ষিতের হাতে। ঔপনিবেশিক নয়, কিন্তু আগের মতােই শ্রেণিবিভক্ত। তাই সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সকলের অধিকার সমান নয় এবং এক শ্রেণির সৃষ্ট সংস্কৃতিতে অন্য শ্রেণির প্রবেশাধিকার নেই; আবার এক শ্রেণির সৃষ্ট সংস্কৃতি অন্য শ্রেণির পক্ষে রুচিকর নয়। 

সমাজের বৈপ্লবিক পরিবর্তন না হলে এই অবস্থার কোনাে বদল আশা করা যায় না। আঠারাে শতক পর্যন্ত বাংলার সংস্কৃতিকে এক অর্থে ধর্মমুখী বলা যায়। বৈষ্ণব সাহিত্য বা মঙ্গলকাব্য, ইসলাম ধর্মবিষয়ক রচনা বা নবিজীবনী, কীর্তন বা শ্যামাসঙ্গীত তার উদাহরণ। এমনকি অধ্যাত্ম-তত্ত্বাশিত প্রণয়ােপাখ্যানও এর মধ্যে ধরা যায়। তবে এক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয় লক্ষণীয়। 

প্রথমত, বাংলার সাহিত্য ও সঙ্গীতে নানা ধর্মসম্প্রদায়ের বক্তব্য একই সঙ্গে স্থান পেয়েছে। দ্বিতীয়ত, ধর্মকলহের পাশাপাশি এক ধরনের সমন্বয়- চেতনা কাজ করেছে- যােগ ও সুফিবাদের সমন্বয় আর বাউল গান তার মধ্যে বিশেষ উল্লেখযােগ্য। তৃতীয়ত, এর সবক্ষেত্রেই শেষ পর্যন্ত ধর্মীয় বস্তুর চেয়ে বড় হয়ে উঠেছে মানবিকতা। 

বৈষ্ণব কবিতা বা আধ্যাত্মিক প্রণয়কাহিনী তত্ত্বের চেয়ে প্রেমের কাহিনীরূপেই আদৃত হয়েছে, মঙ্গলকাব্যে দেবতার চেয়ে বড় হয়ে উঠেছে মানুষ। অবৈষ্ণব কবি রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক পদ লিখেছেন, অমুসলমান কবি লিখেছেন কারবালা-কাহিনী।

এই মানবিকতাকে যদি বাঙালি সংস্কৃতির একটা মুখ্য প্রকাশ বলে গণ্য করি, তাহলে উনিশ-বিশ শতকের বাংলা সংস্কৃতিতে সেই মানববাদের বিচিত্র রূপ প্রত্যক্ষ করি। পুরনাে ধারার সংস্কৃতিতে সামাজিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে কিছু প্রতিবাদ আছে। 

একালের সংস্কৃতিতে অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের কথা সরবে শােনা যায়। এই দিক দিয়ে দেখলে আমাদের সংস্কৃতির প্রবহমান ধারায় মানবকল্যাণ ও সামাজিক ন্যায়ের প্রতি সুস্পষ্ট পক্ষপাত ফুটে উঠেছে। আমাদের সংস্কৃতির বিচিত্র রূপ নিয়ে যেমন আমরা গর্ব করতে পারি, তেমনি তার এই ভাববস্তুও আমাদের গৌরবের বিষয়। ] 

লেখক-পরিচিতি আনিসুজ্জামান

আনিসুজ্জামান ১৯৩৭ সালের ১৮ই ফেব্রুয়ারি কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ডা. এ.টি.এ.এম, মােয়াজ্জম, মাতা সৈয়দা খাতুন। ১৯৫১ সালে ঢাকার প্রিয়নাথ হাইস্কুল থেকে তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৫৩ সালে জগন্নাথ কলেজ থেকে আই.এ. এবং ১৯৫৬ ও ১৯৫৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসহ স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। 

বর্তমানে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান গবেষক ও প্রাবন্ধিক। তাঁর উল্লেখযােগ্য গ্রন্থগুলাে হলাে : মুসলিম বাংলার সাময়িক পত্র, স্বরুপের সন্ধানে, আঠারাে শতকের বাংলা চিঠি, পুরােনাে বাংলা গদ্য, বাঙালি নারী : সাহিত্যে ও সমাজে ইত্যাদি। সাহিত্য ও গবেষণায় কৃতিত্বের জন্য তিনি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, আলাওল সাহিত্য পুরস্কার, একুশে পদকসহ প্রচুর সম্মাননা ও পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। 

আরও পড়ুন

  1. একাত্তরের দিনগুলি | জাহানারা ইমাম 
  2. লাইব্রেরি পরিচয় | মােতাহের হােসেন চৌধুরী
  3. শিক্ষা ও মনুষ্যত্ব কাকে বলে | মােতাহের হােসেন চৌধুরী
  4. অভাগীর স্বর্গ | শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

About sujan

Check Also

এইচএসসি পরীক্ষার রুটিন ২০২৫ HSC Routine 2025

এইচএসসি পরীক্ষার রুটিন ২০২৫| HSC Routine 2025 PDF Download

এইচএসসি পরীক্ষার রুটিন ২০২৫| HSC Routine 2025 PDF Download: পরীক্ষার্থী ও অভিবাবকদের অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রথম …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *