একাত্তরের দিনগুলি | জাহানারা ইমাম: এছাড়া মুক্তিযােদ্ধাদের আশ্রয়, খাদ্যের জোগান, গাড়িতে অস্ত্র আনা-নেওয়া এবং তা যুদ্ধক্ষেত্রে পৌছে দেওয়া, খবর আদান-প্রদান ইত্যাদি কর্মকাণ্ডে তিনি সর্বান্তকরণে অংশগ্রহণ করেন। যুদ্ধের শেষদিকে। রুমী শহিদ হন। জাহানারা ইমাম হন আমাদের শহিদ জননী। মুক্তিযুদ্ধের ওপর স্মৃতিচারণমূলক তাঁর অসাধারণ গ্রন্থ ‘একাত্তরের দিনগুলি সর্বত্র সমাদৃত। তার অন্যান্য গ্রন্থ হলাে : গজকচ্ছপ, সাতটি তারার ঝিকিমিকি, ক্যান্সারের সঙ্গে বসবাস, প্রবাসের দিনগুলি ইত্যাদি।
সাহিত্যকর্মে অবদানের জন্য তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। একাত্তরের ঘাতক দালাল, রাজাকার, আলবদর, আলশামসদের শাস্তির দাবিতে তিনি আমৃত্যু সংগ্রাম করেছেন। ১৯৯৪ সালের ২৬শে জুন এই মহীয়সী নারী পরলােকগমন করেন।]
একাত্তরের দিনগুলি
১৩ই এপ্রিল : মঙ্গলবার ১৯৭১
চারদিন ধরে বৃষ্টি। শনিবার রাতে কি মুষলধারেই যে হলাে, রােববার তাে দিনভর একটানা। গতকাল সকালের পর বৃষ্টি থামলেও সারা দিন আকাশ মেঘলা ছিল। মাঝে মাঝে রােদ দেখা গেছে। মাঝে মাঝে এক পশলা বৃষ্টি। জামী ছড়া কাটছিল, ‘রােদ হয় বৃষ্টি হয়, খাক-শিয়ালির বিয়ে হয়। কিন্তু আমার মনে পাষাণভার।
এখন সন্ধ্যার পর বৃষ্টি নেই, ঘনঘন মেঘ ডাকছে আর বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। বসার ঘরে বসে জানালা দিয়ে তাকিয়ে ভাবছিলাম, আমার জীবনেও এতদিনে সত্যি সত্যি দুর্যোগের মেঘ ঘন হয়ে আসছে। এই রকম সময়ে করিম এসে ঢুকল ঘরে, সামনে সােফায় বসে বলল, ‘ফুফুজান এ পাড়ার অনেকেই চলে যাচ্ছে বাড়ি ছেড়ে। আপনারা কোথাও যাবেন না?
‘কোথায় যাব? অন্ধ, বুড়াে শ্বশুরকে নিয়ে কেমন করে যাব? কিন্তু এ পাড়া ছেড়ে লােকে যাচ্ছে কেন? এখানে তাে কোনাে ভয় নেই! ‘নেই, মানে? পেছনে এত কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলােহল তাে সব খালি, বিরান, যা হবার তা তাে প্রথম দুদিনেই হয়ে গেছে। জানাে,বাবুদের বাড়িতে তার মামার বাড়ির সবাই এসে উঠেছে শান্তিনগর থেকে?
“তাই নাকি? আমরা তাে ভাবছিলাম শান্তিনগরে আমার দুলাভাইয়ের বাসায় যাব। ‘তাহলেই দেখ-ভয়টা আসলে মনে। শান্তিনগরের মানুষ এলিফ্যান্ট রােডে আসছে মিলিটারির হাত থেকে পালাতে, আবার তুমি এলিফ্যান্ট রােড থেকে শান্তিনগরেই যেতে চাচ্ছ নিরাপত্তার কারণে।
যুক্তিটা বুঝে করিম মাথা নাড়ল, ‘খুব দামি কথা বলেছেন ফুফুজান। আসলে যা কপালে আছে তা হবেই। নইলে দ্যাখেন না, ঢাকার মানুষ খামােকা জিঞ্জিরায় গেল গুলি খেয়ে মরতে। আরাে একটা কথা শুনেছেন ফুফুজান? নদীতে নাকি প্রচুর লাশ ভেসে যাচ্ছে। পেছনে হাত বাঁধা, গুলিতে মরা লাশ।’ শিউরে উঠে বললাম, “রােজই শুনছি করিম।
যেখানেই যাই এছাড়া আর কথা নেই। কয়েকদিন আগে শুনলাম ট্রাকভর্তি করে তুলে নিয়ে যাচ্ছে হাত আর চোখ বেঁধে, কতাে লােকে দেখেছে। এখন শুনছি সদরঘাট, সােয়ারীঘাটে নাকি দাঁড়ানাে যায় না পচা লাশের দুর্গন্ধে। মাছ খাওয়াই বাদ দিয়েছি এজন্যে।
১০ই মে : সােমবার ১৯৭১
বেশ কিছুদিন বাগানের দিকে নজর দেওয়া হয় নি। আজ সকালে নাশতা খাবার পর তাই বাগানে গেলাম। বাগানে বেশ কটা হাইব্রিড টি-রােজের গাছ আছে। এই ধরনের গােলাপ গাছের খুব বেশি যত্ন করতে হয়- যা গত দুমাসে হয়নি। খুরপি হাতে কাজে লাগার আগে গাছগুলাের দিকে তাকিয়ে দেখলাম। মাখনের মতাে রঙের ‘পিস’ অর্থাৎ ‘শান্তি’। কালচে-মেরুর বনি প্রিন্স’ আর ‘এনা হার্কনেস। ফিকে ও গাঢ় বেগুনি রঙের ‘সিমােন’ আর ‘ল্যাভেন্ডার।
হলুদ বুকানিয়ার’, সাদা পাস্কালি’। বনি প্রিন্স-এর আধফোটা কলিটি এখনাে আমার বেড-সাইড টেবিলে কালিদানিতে রয়েছে। কলি অবশ্য আর নেই, ফুটে গেছে এবং প্রায় ঝরে পড়ার অবস্থা। পিস’-এর গাছটায় একটা কলি কেবল এসেছে- যদিও সারাদেশ থেকে পিস’ উধাও। বাগান করা একটা নেশা।
এ নেশায় দুঃখ-কষ্ট খানিকক্ষণ ভুলে থাকা যায়। গত কয়েক মাস ধরে নেশাটার কথা ভাববারই অবকাশ পাই নি। এখন ভয়ানক বিক্ষিপ্ত মনকে ব্যস্ত রাখার গরজেই বােধ করি নেশাটার কথা আমার মনে পড়েছে।
১২ই মে : বুধবার ১৯৭১
জামীর স্কুল খুলেছে দিন দুই হলাে। সরকার এখন স্কুল-কলেজ জোর করে খােলার ব্যবস্থা করছে। এক তারিখে প্রাইমারি স্কুল খােলার হুকুম হয়েছে, নয় তারিখে মাধ্যমিক স্কুল। জামী স্কুলে যাচ্ছে না। যাবে না। শরীফ, আমি, রুমী, জামী- চারজনে বসে আলাপ-আলােচনা করে আগেই ঠিক করে রেখেছিলাম স্কুল খুললেও স্কুলে যাওয়া হবে না।
দেশে কিছুই স্বাভাবিকভাবে চলছে না, দেশে এখন যুদ্ধাবস্থা। দেশবাসীর ওপর হানাদার পাকিস্তানি জানােয়ারদের চলছে নির্মম নিষ্পেষণের স্টিমরােলার। এই অবস্থায় কোনাে ছাত্রের উচিত নয় বই-খাতা বগলে স্কুলে যাওয়া। জামী অবশ্য বাড়িতে পড়াশােনা করছে। এবার ও দশম শ্রেণির ছাত্র। রুমী যতদিন আছে, ওকে সাহায্য করবে।
তারপর শরীফ আর আমি- যে যতটা পারি। জামী তার দু-তিনজন বন্ধুর সাথে ঠিক করেছে- ওরা একসঙ্গে বসে আলােচনা করে পড়াশােনা করবে। এটা বেশ ভালাে ব্যবস্থা, পড়াও হবে, সময়টাও ভালাে কাটবে। অবরুদ্ধ নিষ্ক্রিয়তায় ওরা পিয়ে উঠবে না।
১৭ই মে : সােমবার ১৯৭১
রেডিও-টিভিতে বিখ্যাত ও পদস্থ ব্যক্তিদের ধরে নিয়ে প্রােগ্রাম করিয়েও কর্তাদের তেমন সুবিধা হচ্ছে না বােধ হয়! তাই এখন বুদ্ধিজীবী ও শিল্পীদের ধরে ধরে তাদের দিয়ে খবরের কাগজে বিবৃতি দেওয়ানাের কূটকৌশল শুরু হয়েছে। আজকের কাগজে ৫৫ জন বুদ্ধিজীবী ও শিল্পীর নাম দিয়ে এক বিবৃতি বেরিয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনাে টিচার, রেডিও-টিভির কোনাে কর্মকর্তা ও শিল্পীর নাম বাদ গেছে বলে মনে হচ্ছে না। এঁদের মধ্যে কেউ কেউ সানন্দে এবং সাগ্রহে। সই দিলেও বেশিরভাগ বুদ্ধিজীবী ও শিল্পী যে বেয়নেটের মুখে সই দিতে বাধ্য হয়েছেন, তাতে আমার কোনাে সন্দেহ নেই। আর যে বিবৃতি তাদের নামে বেরিয়েছে, সেটা যে তারা অনেকে না দেখেই সই করতে বাধ্য হয়েছেন, তাতেও আমার সন্দেহ নেই।
আজ সকালের কাগজে বিবৃতিটি প্রথমবারের মতাে পড়ে তারা নিশ্চয় স্তম্ভিত হয়ে বসে রইবেন খানিকক্ষণ! এবং বলবেন, ধরণী দ্বিধা হও! এরকম নির্লজ্জ মিথ্যাভাষণে ভরা বৃিবতি স্বয়ং গােয়েবলসও লিখতে পারতেন কিনা সন্দেহ। এই পূর্ব বাংলার কোন প্রতিভাধর বিবৃতিটি তৈরি করেছেন, জানতে বড় ইচ্ছে হচ্ছে।
২৫ শে মে : মঙ্গলবার ১৯৭১
আজ বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মজয়ন্তী। বেশ শান-শওকতের সঙ্গে পালিত হচ্ছে। ঢাকায়। এমনকি ইসলামিক ফাউন্ডেশন পর্যন্ত একটা অনুষ্ঠান করছে। সন্ধ্যার পর টিভির সামনে বসেছিলাম, জামী সিঁড়ির মাথা থেকে মুখ বাড়িয়ে ডাকল, ‘মা শিগগির এস। নতুন প্রােগ্রাম।
দৌড়ে ওপরে গেলাম, স্বাধীন বাংলা বেতারে বাংলা সংবাদ পাঠ করছে নতুন এক কণ্ঠস্বর। খানিক শােনার পর চেনা চেনা ঠেকল কিন্তু ঠিক চিনে উঠতে পারলাম না। সালেহ আহমদ নামটা আগে কখনাে শুনি নি। রুমী বলল, “নিশ্চয় ছদ্মনাম। বললাম, হতে পারে।
তবে ঢাকারই লােক এ। এই ঢাকাতেই এই গলা শুনেছি। হয় নাটক, নয় আবৃত্তি। এইসব গবেষণা করতে করতে বাংলা সংবাদপাঠ শেষ। আজকের প্রােগ্রামেও বেশ নতুনত্ব। কণ্ঠস্বরও সবই নতুন শুনছি। একজন একটা কথিকা পড়লেনচরমপত্র।
বেশ মজা লাগল শুনতে, শুদ্ধ ভাষায় বলতে বলতে হঠাৎ শেষের দিকে একেবারে খাটি ঢাকাইয়া ভাষাতে দুটো লাইন বলে শেষ করলেন। অদ্ভুত তাে। কিন্তু এখানে আলটিমেটামের মতাে কিছু তাে বােঝা গেল না। শরীফ বলল, “ঐ যে বলল না একবার যখন এ দেশের কাদায় পা ডুবিয়েছ, আর রক্ষে নেই।
গাজুরিয়া মাইরের চোটে মরে কাদার মধ্যে শুয়ে থাকতে হবে, এটা আলটিমেটাম। কি জানি। জামী জানতে চাইল, গাজুরিয়া মাইর কি জিনিস? রুমী বলল, জানি না। আমার ঢাকাইয়া বন্ধু কাউকে জিগ্যেস করে নেব।
ঐ যে মুক্তিফৌজের গেরিলা তৎপরতার কথা বলল- ঢাকার ছ’জায়গায় গ্রেনেড ফেটেছে, আমরা তাে সাত আটদিন আগে এ রকম বােমা ফাটার কথা শুনেছিলাম, কিন্তু ঠিক বিশ্বাস করি নি। ব্যাপারটা তাহলে সত্যি? আমার সারা শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠল।
ব্যাপারটা তাহলে সত্যি! সত্যি সত্যি তাহলে ঢাকার আনাচে-কানাচে মুক্তিফৌজের গেরিলারা প্রতিঘাতের ছােট ছােট ফুলিঙ্গ জ্বালাতে শুরু করেছে? এতদিন জানছিলাম বর্ডারঘেঁষা অঞ্চলগুলােতেই গেরিলা তৎপরতা। এখন তাহলে খােদ ঢাকাতেও? মুক্তিফৌজ!
কথাটা এত ভারী যে এই রকম অত্যাচারী সৈন্য দিয়ে ঘেরা অবরুদ্ধ ঢাকা শহরে বসে মুক্তিফৌজ শব্দটা শুনলেও কেমন যেন অবিশ্বাস্য মনে হয়। আবার ঐ অবিশ্বাসের ভেতর থেকে একটা আশা, একটা ভরসার ভাব ধীরে ধীরে মনের কোণে জেগে উঠতে থাকে।
৫ই সেপ্টেম্বর : রবিবার ১৯৭১
একটা কঠিন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবার ব্যাপারে গত দুদিন থেকে শরীফ আর আমি খুব দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছি। রুমীকে কি করে বের করে আনা যায়, তা নিয়ে শরীফের বন্ধুবান্ধব নানারকম চিন্তাভাবনা করছে। এর মধ্যে বাকা আর ফকিরের মত হলাে : যে কোনাে প্রকারে রুমীকে উদ্ধারের চেষ্টা করতে হবে।
বাঁকা আর ফকির মনে করছে- শরীফকে দিয়ে রুমীর প্রাণভিক্ষা চেয়ে একটা মার্সি পিটিশন করিয়ে তদবির করলে রুমী হয়তাে ছাড়া পেয়ে যেতেও পারে। রুমীর শােকে আমি প্রথম চোটে ‘তাই করা হােক’ বলেছিলাম। কিন্তু শরীফ রাজি হতে পারছে না। যে সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে রুমী মুক্তিযুদ্ধে যােগ দিয়েছে, সেই সরকারের কাছে মার্সি পিটিশন করলে রুমী সেটা মােটেও পছন্দ করবে না এবং রুমী তাহলে আমাদের কোনােদিনও ক্ষমা করতে পারবে না।
বাঁকা ও ফকির অনেকভাবে শরীফকে বুঝিয়েছে- ছেলের প্রাণটা আগে। রুমীর মতাে এমন অসাধারণ মেধাবী ছেলের প্রাণ বাঁচলে দেশেরও মঙ্গল। কিন্তু শরীফ তবু মত দিতে পারছে না। খুনি সরকারের কাছে রুমীর প্রাণভিক্ষা চেয়ে দয়াভিক্ষা করা মানেই রুমীর আদর্শকে অপমান করা, রুমীর উঁচু মাথা হেঁট করা। গত দুরাত শরীফ ঘুমােয় নি, আমি একবার বলেছি, তােমার কথাই ঠিক। ঐ খুনী সরকারের কাছে মার্সি পিটিশন করা যায় না।
আবার খানিক পরে কেঁদে আকুল হয়ে বলেছি, না, মার্সি পিটিশন কর। এইভাবে দ্বিধাদ্বন্দ্বে কেটেছে দুদিন দুরাত। শেষ পর্যন্ত শরীফ সিদ্ধান্ত নিয়েছে- না, মার্সি পিটিশন সে করবে না। চোখের জলে ভাসতে ভাসতে আমিও শরীফের মতকে সমর্থন করেছি। রুমীকে অন্যভাবে বের করে আনার যতরকম চেষ্টা আছে, সব করা হবে; কিন্তু মার্সি পিটিশন করে নয়।
১১ই অক্টোবর : সােমবার ১৯৭১
শরীফ বলল, সেই যে মাস খানেক আগে কাগজে পড়েছিলাম ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিয়ুর রহমানের কথা, তার সম্বন্ধে আজ শুনে এলাম।
কী শুনে এলে? কোথায় শুনলে? ‘ডা. রাব্বির কাছে। রাব্বি জানাে তাে, আমাদের সুজার ভাস্তে। # শরীফের এক ইঞ্জিনিয়ার বন্ধু সুজা সাহেব, তাঁর ভাস্তে ডা. ফজলে রাব্বি।
শরীফ বলল, “আজ ফকিরের অফিসে গেছিলাম, ওখানে রাব্বির সঙ্গে দেখা। ওর মুখেই শুনলাম মতিয়ুর রহমানের ফ্যামিলি ২৯ সেপ্টেম্বর করাচি থেকে ঢাকা এসেছে। মতিয়ুর রহমানের শ্বশুর গুলশানের এক বাড়িতে থাকেন। সেইখানে ৩০ তারিখে মতিয়ুরের চল্লিশা হয়েছে।
রাব্বি গিয়েছিল চল্লিশায়। মিসেস মতিয়ুর নাকি বাংলা বিভাগের মনিরুজ্জামানের শালী। ‘আমাদের স্যার মনিরুজ্জামানের? তার মানে ডলির বােন? দাঁড়াও, দাঁড়াও- এই বােনকে তাে দেখেছি ডলিদের বাসায় মিলি এর নাম। ডলির কথা মনে পড়ে মনটা খারাপ হয়ে গেল। ডলি, মনিরুজ্জামান স্যার, ওদের কোনাে খোঁজই জানি না। দুটো বাচ্চা নিয়ে কোথায় যে ভেসে ভেসে বেড়াচ্ছে কে জানে। ওপারেও যায় নি, গেলে বেতারে নিশ্চয় গলা শুনতে পেতাম।
স্বাধীন বাংলা বেতারে বহু পরিচিতজনের গলা শুনি, তারা ছদ্মনাম ব্যবহার করে, কিন্তু গলা শুনে চিনতে পারি। প্রথম যেদিন স্বাধীন বাংলা বেতারে সালেহ আহমদের কণ্ঠে খবর শুনি, খুব চেনা চেনা লেগেছিল, দু একদিন পরেই চিনেছিলাম- সে কণ্ঠ হাসান ইমামের। ইংরেজি খবর ও ভাষ্য প্রচার করে যারা, সেই আবু মােহাম্মদ আলী ও আহমেদ চৌধুরী হলাে আলী যাকের আর আলমগীর কবির।
গায়কদের গলা তাে সহজেই চেনা যায়- রথীন্দ্রনাথ রায়, আবদুল জব্বার, অজিত রায়, ইন্দ্রমােহন রাজবংশী, হরলাল রায়। কথিকায় সৈয়দ আলী আহসান, কামরুল হাসান, ফয়েজ আহমদ প্রায় সকলেরই গলা শুনে বুঝতে পারি । নাটকে রাজু আহমেদ, মাধুরী চট্টোপাধ্যায়- এদের সবার গলাই এক লহমায় বুঝে যাই।
১৬ই ডিসেম্বর : বৃহস্পতিবার
১৯৭১ আজ সকাল নটা পর্যন্ত যে আকাশযুদ্ধ-বিরতির কথা ছিল, সেটা বিকেলে তিনটে পর্যন্ত বাড়ানাে হয়েছে। দুপুর থেকে সারা শহরে ভীষণ চাঞ্চল্য ও উত্তেজনা। পাকিস্তানি আর্মি নাকি সারেন্ডার করবে বিকেলে। সকাল থেকে কলিম, হুদা, লুলু যারাই এলাে সবার মুখেই এক কথা। দলে দলে লােক ‘জয় বাংলা’ধ্বনি তুলে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছে কারফিউ উপেক্ষা করে। পাকিস্তানি সেনারা, বিহারিরা সবাই নাকি পালাচ্ছে।
পালাতে পালাতে পথেঘাটে এলােপাথাড়ি গুলি করে বহু বাঙালিকে খুন-জখম করে যাচ্ছে। মঞ্জুর এলেন তার দুই মেয়েকে নিয়ে, গাড়ির ভেতরে বাংলাদেশের পতাকা বিছিয়ে। তিনিও ঐ এক কথাই বললেন। বাদশা এসে বলল, এলিফ্যান্ট রােডের আজিজ মােটরসের মালিক খান জীপে করে পালাবার সময় বেপরােয়া গুলি চালিয়ে রাস্তার বহু লােক জখম করেছে। মঞ্জুর যাবার সময় পতাকাটা আমাকে দিয়ে গেলেন।
বললেন, ‘আজ যদি সারেন্ডার হয়, কাল সকালে এসে পতাকাটা তুলব। আজ শরীফের কুলখানি। আমার বাসায় যাঁরা আছেন, তাঁরাই সকাল থেকে দোয়া দরুদ কুল পড়ছেন। পাড়ার সবাইকে বলা হয়েছে বাদ মাগরেব মিলাদে আসতে। এ.কে.খান, সানু, মঞ্জু, খুকু সবাই বিকেল থেকেই এসে কুল পড়ছে। জেনারেল নিয়াজী নব্বই হাজার পাকিস্তানি সৈন্য নিয়ে আত্মসমর্পণ করেছে আজ বিকেল তিনটের সময়। যুদ্ধ তাহলে শেষ?
তাহলে আর কাদের জন্য সব রসদ জমিয়ে রাখব? আমি গেস্টরুমের তালা খুলে চাল, চিনি, ঘি, গরম মসলা বের করলাম কুলখানির জর্দা রাঁধবার ও জন্য। মা, লালু, অন্যান্য বাড়ির গৃহিণীরা সবাই মিলে জর্দা রাঁধতে বসলেন।
রাতের রান্নার জন্যও চাল, ডাল, আলু, পেঁয়াজ ইত্যাদি এখান থেকেই দিলাম। আগামীকাল সকালের নাশতার জন্যও ময়দা, ঘি, সুজি, চিনি, গরম মসলা এখান থেকেই বের করে রাখলাম। ]
একাত্তরের দিনগুলি লিখেছেন জাহানারা ইমাম
[লেখক-পরিচিতি : জাহানারা ইমাম ১৯২৯ সালের ৩রা মে মুর্শিদাবাদের সুন্দরপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম সৈয়দ আব্দুল আলী। তিনি ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। জাহানারা ইমাম ১৯৪৭ সালে কলকাতার লেডি ব্রেবোের্ন কলেজ থেকে বি.এ. পাস করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি ঢাকার সিদ্ধেশ্বরী গার্লস স্কুলে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন।এ সময় তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.এড ও বাংলায় এম.এ. ডিগ্রি লাভ করেন এবং ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজে অধ্যাপনা করেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে তাঁর প্রথম সন্তান রুমী যােগদান করেন। রুমী ও তাঁর সহযােদ্ধাদের বিভিন্ন অপারেশনে জাহানারা ইমাম সহযােগিতা করেন। ]